রহিম উদ্দিন,
আমরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার কথা বলতে ২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালের কালো রাত্রি তথা পাকিস্তানি আর্মির বর্বর হত্যাযজ্ঞ এবং রায়ের বাজার বদ্ধ ভূমির গণহত্যাকেই বুঝি। কিন্তু, দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলার কত জায়গার এমন নির্মম গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে সেই বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। ঠিক সেইরকম একটা লোমহর্ষক গণহত্যা সংঘটিত হয় পটিয়া উপজেলার মোজাফফরাবাদ গ্রামে, যা ‘মুজাফফরাবাদ গণহত্যা ‘ নামে পরিচিত। আসুন, এইবার জেনে নিই মোজাফফরাবাদ গণহত্যার আদ্যোপান্ত।
১৯৭১ সালের ৩ মে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী স্থানীয় সহযোগীদের ( রাজাকারদের ) সহায়তায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার খারনা ইউনিয়নের অধীনে মুজফফারাবাদের গ্রামে ( মূলত হিন্দু বাসিন্দাদের উপরে ) গণহত্যা চালায়।এই গণহত্যায় আনুমানিক ৩০০ বাঙালি হিন্দু হত্যার শিকার হয় । এইছাড়াও প্রায় ৫ শতাধিক ঘর বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল।
স্থানীয় অনেকেই মনে করেন, খারনা ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান রমিজ আহমেদ চৌধুরী এবং তার সহযোগীরা এই গণহত্যার জন্য দায়ী ছিলেন।
মুজাফফারাদ কেন পাকিস্তানিদের গণহত্যার টার্গেট হলোঃ
পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার দক্ষিণ পূর্ব সীমান্তে, খারনা ইউনিয়নের অধীনে মুজাফফারাবাদ গ্রামটি অবস্থিত। কথিত আছে,১৯৭১ সালে পটিয়া থানার অধীনে মুজফফারাবাদ অন্যতম হিন্দু গ্রাম ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মুজাফফরাবাদের ৯৫% ভোটার আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ২৫ শে মার্চ সারা বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দমন শুরু হলে চট্টগ্রামের বহু লোক মোজাফফারাবাদে তাদের আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাকিস্তানিরা পটিয়ায় শিবির স্থাপনের ফলে, এপ্রিলের শেষের দিকে, খারনা এবং এলাহাবাদ গ্রাম থেকে রাজাকাররা হিন্দু গ্রামে নির্যাতন ও লুটপাটের জন্য টার্গেট করেছিল। তাদের গ্রামে ঘন ঘন দেখা যেতে শুরু করার সাথে সাথে বয়োজ্যৈষ্ঠ সবাই একটি গ্রাম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। গ্রামের সীমান্তে বিশ টি শিবির স্থাপন করা হয়েছিল, প্রত্যেকের জন্য চৌকোশ বিশ পুরুষ ছিল। কোনও আক্রমণ হলে শিবিরের পুরুষরা আতঙ্ক তৈরি করে যাতে অন্যান্য শিবিরের পুরুষরা একত্র হয়ে আক্রমণকারীদের প্রতিরোধ করে। শিবিরগুলির সর্বাত্মক নজরদারির জন্য গ্রামবাসী রাজাকারদের আক্রমণকে অনেকবার ব্যর্থ করতে পেরেছিল। ব্যর্থ হয়ে, রাজাকাররা দোহাজারী শিবিরে পাকিস্তানী দখলদার সেনাদেরকে মুজাফফারাবাদ আক্রমণ করার জন্য রাজি করায়। ফলশ্রুতিতে, ৩মে ১৯৭১ সালে, ভোর ৫ টা ২০ মিনিটের দিকে মুজাফফারাবাদের লোকেরা যখন ঘুমিয়ে ছিল, তখন পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী এবং রাজাকাররা তিন দিক থেকে গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। সকাল ৭ টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সামরিক ট্রাকে করে গ্রামে প্রবেশ করে। সকাল আটটার দিকে তারা ঘরে ঘরে গিয়ে গ্রামবাসীদের হত্যা শুরু করে। লোকমুখে শোনা যায়, সত্তর বছর বয়সী রজনী সেন সে সময় দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য রামায়ণ পাঠ করছিলেন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং রাজাকাররা সে জায়গায় উপস্থিত হলে, তিনি তাদের অতিথি হিসাবে বসেন। রাজাকারদের একজন সেনকে জয় বাংলা বলতে বললেন। তিনি জয় বাংলা উচ্চারণ করার সাথে সাথেই একজন পাকিস্তানী সৈনিক তার রাইফেলের পিপা রজনী সেনের গলায় ঢুকিয়ে গুলি করে হত্যা করে। গ্রামের অন্য বাড়িতে গীতা থেকে আবৃত্তি করছিলেন ৭৫ বছর বয়সী নবীন সাধু, একইভাবে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। আক্রমণকারীরা গ্রামের পুরোহিতকে ঘিরে ফেলে এবং তাদের পূজা করার মূর্তিগুলো ভাঙতে বাধ্য করে। এরপরে পুরোহিতদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।
সমাজ সেবক নির্মল সেনকে তার বাবা উপেন্দ্রলাল সেনের সাথে কাছের ধান ক্ষেতে টেনে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের গামছা দিয়ে বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হয়। গ্রামের পুকুরে মাছ ধরতে শুরু করা মোজাফফারাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক রায়মোহানকে তার ছেলের সাথে মাছের জালে বেঁধে এবং পরে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। যে গ্রামবাসীরা আত্মগোপনে ছিল, যখন পাকিস্তানী দখলদার সেনা হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছিল তখন রাজাকারদের একেকটি দলে ভাগ করে দেয়া হয়। তারা হিন্দু বা মুসলমান কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য গ্রামবাসীদের কালেমা তেলাওয়াত করতে বলে। যখন তারা ব্যর্থ হয়েছিল, তাদের জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল। এইভাবে দুপুর ২ টা অবধি হত্যাকাণ্ড চলে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চলে যাওয়ার পরে স্থানীয় রাজাকাররা বাকী বাড়িগুলি লুট করে। ৩ মে গণহত্যার পরেও লক্ষ্যবস্তু হত্যা অব্যাহত ছিল। ৭ই বা ৮ই মে, নাটুন চন্দ্র চৌধুরীকে এলাহাবাদ থেকে কয়েকজন রাজাকার নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। এর কিছুদিন পর মুজাফফরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক বারেন রায় চৌধুরীকে হত্যা করা হয়। তিনি তার অসুস্থ মায়ের ওষুধ কিনতে জোয়ারা মুনসিরহাটে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে মোহাম্মদপুরের নিকটে রাজাকাররা তাকে হত্যা করে। এইভাবেই একে একে শেষ করে প্রায় তিনশো নারী পুরুষ ও শিশু। যার রক্তক্ষরণ আজো মুজাফফারাদ গ্রামে দেখতে পাওয়া যায়।
বর্তমানে প্রতি বছর মুজফফারাবাদের লোকেরা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সারা দিন বক্তৃতা, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, ৩মে ‘ মুজাফফারাবাদ গণহত্যা দিবস ‘ উদযাপন করে। এইছাড়াও, মুজাফফারাবাদ এলাকায়, ২০১০ সালে গণহত্যার স্মরণে একটি নতুন স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে।
লেখক: রহিম উদ্দিন
কবি ও প্রাবন্ধিক