এমএসাত্তার,
নানান দুর্নীতি, বিভিন্ন প্রকল্পের অনিয়ম, অবৈধ পন্থায় বিত্তবৈভব অর্জন, মাদক বাণিজ্য, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থের নিরীহ মনুষকে মিথ্যা মামলা হয়রানী, চাঁদাবাজি, লুটপাট, ঘুষ বাণিজ্যে, গ্রামীণ অবকাঠামো ও রাস্তাঘাট নির্মাণের টাকা ভাগ বাটোয়ারা, কাবিখা, টাবিখা, টিআর, বিভিন্ন কর্মসূচির নামে লুটপাট স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বারদের এখন প্রধান কাজ।
যে কোনো মূল্যে যে পদই হোক একবার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে পারলেই অবৈধ বিত্তসম্পদের মালিক হচ্ছেন তারা। রীতিমতো এই মহৎ পেশা এখন লোভের দাসে পরিনত হয়েছে। এমন সংবাদ উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। খবরটা অতিদুঃখের এবং হতাশার বটে। কেননা জনগণ স্থানীয় সরকার ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলা পরিষদে সেবা পাওয়ার কথা। এর পরিবর্তে চেয়ারম্যান মেম্বারগণ যদি ঘুষ দুনীর্তিতে জড়িত হয় তাহলে জনগণ কোথায় যাবে? অথচ ইউনিয়ন পরিষদকে সরকারের পক্ষে সকল নাগরিকের আশ্রয়স্থল বিবেচিত করা হয়। বিধায় সেখানে পরিছন্নতার প্রয়োজন আছে। সবার ধারনা প্রকৃত সেবা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য সরকার প্রথম বারের মতো দলীয় প্রতিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করেছে। উদ্দেশ্য সরকারের গৃহিত সকল উন্নয়ন যথাযথ পালন করে চেয়ারম্যান মেম্বারগণ সাধারণ জনগনের মাঝে সকল উন্নয়ন পৌঁছে দিতে সহযোগিতা করবে। তাতে সরকারের বহুমূখী উন্নয়ন জনগণের দোরগোড়ায় খুব সহজে পৌঁছে যাবে। কিন্তু এ পর্যন্ত কতটা ব্যাস্তবায়ন হয়েছে তা একবার খতিয়ে দেখা দরকার। গত ৮ জুলাই জাতীয় একটি দৈনিকের শিরোনাম ছিল ‘খুন মাদক বাণিজ্য চাঁদাবাজিতে তৃণমূল জনপ্রতিনিধিরা’ গুরুত্বপূর্ন এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরা জড়িয়ে পড়ছে নানা অনিয়ম ও গুরুতর অপরাধমূলক কর্মকান্ডে।
মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে সেবা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বর্তমানে নিজ নিজ এলাকায় হয়ে উঠেছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক। তৃণমূলের এসব জনপ্রতিনিধি খুন, অস্ত্র ও মাদক বাণিজ্যসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ভয়াবহ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে। অনেক জনপ্রতিনিধি গ্রাম্য সালিসের নামে নিজ নিজ এলাকায় কায়েম করেছেন ঘুষের রাজত্ব। আবার কোথাও কোথাও ইউপি জনপ্রতিনিধিদেরকে দুর্নীতির ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে কিছু অসাধু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। গত এক বছরে বিভিন্ন অভিযোগে শতাধিক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে বহিষ্কার করেছে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ। এর পরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে জানা যায়। এ ব্যাপারে সচেতন মহল মনে করেন কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এসব বেপরোয়া চেয়ারম্যান ও মেম্বারের লাগাম টেনে ধরতে হবে।
গত ২৯ তারিখ বুধবার এক জাতীয় দৈনিকে বলা হয়েছে ‘পুকুর থেকে বিপুল পরিমান ভিজিএফের চাল উদ্ধার’ তাতে বলা হয়েছে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের ৩টি পুকুর থেকে প্রায় ৩ হাজার কেজি ভিজিএফের পঁচা চাল উদ্ধার করা হয়েছে। এই খবরে মানুষের আর কিছু বুঝার বাকি নাই যে তারা সেবক সেঁজে জনগণকে ধুকা দিয়ে নিজেদের ব্যাংক ব্যালেস বাড়ানোর ধান্ধায় দিনাতিপাত করছে। প্রতিদিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসতেছে এসব সামাজিক ব্যাধির লম্বা খতিয়ান। বিশেষ করে ঘুষদুর্নীতি, বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম, অবৈধ পন্থায় বিত্তশালী, মাদক বাণিজ্য, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থের খুনখারাবি, ব্যাপক চাঁদাবাজি, লুটপাট, বিপুল পরিমাণ ঘুষ-বাণিজ্য সমাজকে আজ ব্যাপকভাবে দূষিত করে চলেছে যে কলংক খোদরাষ্ট্রের গায়ে দাগ তো পড়ছেই আর যে লোক যে দল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন সে দলের জন্য লজ্জাকর ক্ষতির কারণ তো বটেই।
তাই সৎ, যোগ্য, ত্যাগী, মেধাবী, যারা প্রকৃত দেশ ও জনগণের কল্যাণে রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন সেই নেতাদের উচিত হবে নিজ নিজ এলাকার অভিযুক্ত জনপ্রতিনিধিদের লাগাম টেনে ধরা। তা না হলে সামনে নির্বাচনে এরা দলের মহা বিপদের কারণ হতে পারে। চিন্তার বিষয় হলো রাষ্ট্রের গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ, সেখানে ইউনিয়ন পরিষদ যদি ব্যাধিগ্রস্থ ও দূর্নীতিগ্রস্থ হয় তাহলে জনগণ সেবার জন্য কোথায় যাবে। সেবা নিতে এসে যদি টাকা গুনতে হয়, দুস্থমাতা, ভিজিএফ, ভিজিডি নিতে যদি তাদের খুশি করতে হয় তাহলে দারিদ্র বিমোচন হবে কি করে আর জনগণই যাবে কোথায়। গ্রামীণ প্রকল্পের সিংহভাগ টাকা যদি চেয়ানম্যান, মেম্বার, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায় কর্মকর্তার পকেটে যায় তাহলে রাষ্ট্রে কোনদিন উন্নয়নের মুখ দেখবেনা। এক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসন যদি তাদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করে তাহলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দূর্নীতি অনেকটা রোধ করা সম্ভব হবে। কেননা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার স্বাক্ষর ছাড়া কোন প্রকল্পের বিল ছাড়া হয়না।
সদর উপজেলার পিএমখালীর একজন সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার ঘুষদুর্নীতিসহ নানান অনিয়মের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠছে। এ নিয়ে চলিত মাসের ২ তারিখ কক্সবাজারের স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক আপন কন্ঠে ধারাবাহিকভাবে তথ্যবহুল সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।এ প্রতিবেদন পড়ে জানা যায় উক্ত মহিলা মেম্বার ও তার স্বামী সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প ভিত্তিত ভাতার বই, সরকারি ঘর, গর্ভবর্তী ভাতা, ভিজিডি কার্ড করে দেয়ার প্রলোভনে এলাকার সহজ সরল গরীব দুস্থ বিধবা পঙ্গুসহ সহায়সম্বলহীন মানুষের নিকট থেকে হাজার হাজার টাকা নেয়ার পরও মানুষকে হয়রানি করা হচ্চে তার। তাদের এ দুর্নীতির খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকা তোড়পাড় সৃষ্টি হয়। এলাকা ভিত্তিক যেসব জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন সচেতন মহলের একপক্ষ।
গত ২৩ জুলাই সমকাল পত্রিকায় বিশিষ্ট কবি প্রাবন্ধিক আহমদ রফিক তার উপসম্পাদকীয়তে লিখেছেন‘ অভিযোগের ফিরিস্তি অনেক লম্বা। খুব সংক্ষেপে বলতে হচ্ছে স্থানীয় ‘জনপ্রতিনিধিরা খুন, অস্ত্র ও মাদক বাণিজ্য, বালুদস্যুতাসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ভয়াবহ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন কায়েম করেছেন ঘুষের রাজত্ব। নিজ নিজ এলাকায় এরা মূর্তিমান আতঙ্ক। ইউপি চেয়ারম্যানদের দুর্নীতির ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে উপজেলার কিছু অসাধু প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা।’ অর্থাৎ শর্ষের মধ্যেই ভূত।
এ ভূত তাড়ানো ফরয হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁর যুক্তিনিষ্ঠ দাবি এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন।’ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরী কেননা স্থানিয় সরকারের নিম্নস্তর থেকে যদি দূর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলে তা এক সময় মহামারী রুপ নিতে পারে আর তার বলি হবে সাধারণ জনগণ।সে ক্ষেত্রে দলীয় নেতাকর্মী স্থানীয় সংসদ সদস্য ও দূর্নীতিদমন কমিশনের সজাগ দৃষ্টির প্রয়োজন। তা না হলে দূর্নীতিবাজ চেয়ারম্যান মেম্বারদের রুখা কঠিন হবে। তাদের দূর্নীতির শিকল টানতে না পারলে সরকার গ্রামের ভাগ্যবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে গৃহীত যুগান্তকারী সকল পদক্ষেপ ভেস্তে যেতে পারে।
তখন দুস্থ অসহায় মানুষের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত সিংহভাগ অর্থ ঐ সমস্ত দুর্নীতিবাজ জনপ্রতিনিধিদের পকেটেই থাকবে। ইতিপূর্বে যে সমস্ত যে জনপ্রতিনিধি ঘুষদুর্নীতিতে জড়িত ছিল তাদেরকে চিহ্নিত করে রাখতে হবে। পরবর্তিতে তারা যেন পুন:বার নির্বাচন করে জনপ্রতিনিধি হয়ে ফিরে আসতে না পারে। তাই এখনি এদের লাগাম টেনে ধরতে হবে। নতুবা তারা পূর্বের ন্যায় বীরদর্পে আবার লুটপাট শুরু করবে। একই সঙ্গে গ্রামীণ আবকাঠামো নির্মান, রাস্তাঘাট মেরামত, কাবিখা, টাবিখা, চল্লিশ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচী, বিভিন্ন ভাতাদি সুষ্ঠভাবে বণ্ঠণ হচ্ছে কি না সেই দিকে কর্তৃপক্ষের জোরালো তদারকি প্রয়োজন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় দিন দিন এই সামাজিক ব্যাধি বেড়েই চলছে।
এভাবে চলতে থাকলে একদিন জনপ্রতিনিধির সংজ্ঞাও হারিয়ে যেতে পারে কেননা সম্ভ্রান্ত, শিক্ষিত সৎ,যোগ্যদের কোন স্থান নেই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে। পক্ষান্তরে অবৈধ অর্থের মালিক, সন্ত্রাসী বা পেশিশক্তিতে বলীয়ান চরিত্রহীন ব্যক্তিরাই এলাকার জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন। আর মানসম্মান রক্ষার্থে যোগ্যলোকেরা তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচন করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। কেননা ক্যাডারবাজি ও হতাহতের ভয় প্রত্যেকের কাছে লুকায়িত তো অাছেই। আবার যে কোন নির্বাচনে সৎ যোগ্য, পরিশ্রমি, মেধাবী, ত্যাগী, বিনয়ী লোকেরা যেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সেই ব্যবস্থা বা পরিবেশ তৈরী করা অতিজরুরী। অন্যথায় পিছিয়ে পড়া বিপুল জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে সরকার প্রধান যে পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলছে তা তিমিরেই রয়ে যাবে।
এতে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্র গঠনের যে স্বপ্ন দেখছে তার প্রধান অন্তরায় হবে। যাহোক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচন যেহেতু রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাই স্থানিয় জনপ্রতিনিধিদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, দুর্নীতি ও লুটপাটের দায় অনেকাংশে মনোনয়ন পাওয়া দলের কাঁধে চলে যায়। তখন সেই দল সম্পর্কে জনমনে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে সেই দল ভোটের মাঠে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
লেখক, সাংবাদিক ও এনজিও কর্মি।