মাসুদা আকতার তিশা,বিশেষ প্রতিনিধিঃ
আজ বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস। ১৯৮৯ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছেমানব ইতিহাসের প্রাচীনতম দুরারোগ্য মরণব্যাধিগুলোর মধ্যে হিমোফিলিয়া একটি বংশাণুক্রমিক রক্তক্ষরণজনিত রোগ।রক্তে জমাট বাঁধার উপাদান বা ফ্যাক্টর জন্মগতভাবে কম থাকার কারণে হিমোফিলিয়া রোগটি হয়ে থাকে। এ রোগটি সাধারণত পুরুষের হয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রক্তে ফ্যাক্টর-৮-এর ঘাটতির কারণে হিমোফিলিয়া-এ এবং ফ্যাক্টর-৯ এর অভাবে হিমোফেলিয়া-বি আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে।”বাংলাদেশ ফেডারেশন অব হিমোফেলিয়া” সংগঠন দিবসটি পালনে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করে থাকে।
মানবদেহে রক্ত জমাট বাঁধার জন্য কিছু বিশেষ ব্যবস্থা আছে। রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ায় কাজ করে রক্তের অণুচক্রিকা এবং বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টর (বিষয়)। এদের মধ্যে বিশেষ দুটি ফ্যাক্টর কম মাত্রায় উৎপাদিত হলে রক্তের জমাট বাঁধায় সমস্যা দেখা দেয়। এ রকম পরিস্থিতিতে শরীরের অভ্যন্তরে নিজে নিজেই রক্তক্ষরণ শুরু হতে পারে। একেই বলে হিমোফিলিয়া।
হিমোফিলিয়া দুই ধরনের—হিমোফিলিয়া এ, হিমোফিলিয়া বি। শতকরা ৮৫ ভাগ হিমোফিলিয়া রোগী হিমোফিলিয়া এ-তে আক্রান্ত। হিমোফিলিয়া বি-এর আরেক নাম ক্রিসমাস ডিজিজ।
হিমোফিলিয়া একটি বংশানুক্রমিক জিনগত রোগ। এই রোগের মূল সমস্যা রক্ততঞ্চন। কোথাও কেটে গেলে রক্ত সহজে জমাট বাঁধে না। এই রোগের বাহক মহিলারা আর আক্রান্ত হন পুরুষেরা। কারণ মহিলাদের দুটি এক্স ক্রোমোজম থাকে আর পুরুষদের একটি এক্স একটি ওয়াই থাকে। ফ্যাক্টর viii এর অভাবে হিমোফিলিয়া এ এবং ফ্যাক্টর ix এর অভাবে হিমোফিলিয়া বি রোগ হয়।
এ রোগের লক্ষণগুলো হলো অস্বাভাবিক রক্তরক্ষণ।অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণই হলো হিমোফিলিয়ার প্রধান লক্ষণ।অনেকের দেখা যায় হামাগুড়ি দেওয়ার কারণে হাঁটু ফুলে যায় অথবা সামান্য আঘাতে গিড়া ফুলে যায়। অস্ত্রোপচারের পর বা দুর্ঘটনাজনিত আঘাতের পর রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না।রোগের মাত্রা ও রোগের মেয়াদ অনুযায়ী প্রকাশ পেতে পারে আরো কিছু লক্ষণ। দীর্ঘদিন ধরে অস্থিসন্ধিতে রক্তক্ষরণের কারণে অস্থিসন্ধির কর্মক্ষমতা নষ্ট হতে পারে। এ ছাড়া শরীরের অন্যান্য অংশেও রক্তক্ষরণ হতে পারে। এমনকি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে, যেটা খুবই মারাত্মক। এতে সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা না নিলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই সময় থাকতেই রোগটি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারলে এবং সে অনুযায়ী সতর্ক থাকলে মৃত্যুর ঝুঁকি কমানো যায়। রক্তক্ষরণের মাত্রা নির্ভর করে রক্তে রক্ত জমাট বাঁধার উপাদান (ফ্যাক্টর ৮ ও ৯) কেমন পরিমাণে উপস্থিত আছে তার ওপর।
চিকিৎসকদের মতে, ৮৫ শতাংশ রোগীর হিমোফেলিয়া-এ এবং ১৫ শতাংশ রোগীর হিমোফেলিয়া-বি হয়ে থাকে।
হিমোফেলিয়ার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আমেরিকায় প্রতি ১০ হাজার মানুষের মধ্যে গড়ে একজন হিমোফেলিয়া-এ আক্রান্ত।বাংলাদেশে এ রোগের কোনো গবেষণা ও সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও চিকিৎসকদের ধারণা, দেশে প্রায় ১০ হাজার মানুষ এ রোগে আক্রান্ত।
হিমোফিলিয়ার স্থায়ী কোনো চিকিৎসা নেই। ইনজেকশনের মাধ্যমে সেই ফ্যাক্টর শরীরে প্রবেশ করানোই মূল চিকিৎসা। রক্তক্ষরণের কারণে অস্থিসন্ধিতে সমস্যা দেখা দিলে ফিজিওথেরাপি নিতে হয়। নিয়মিত চিকিৎসা নিলে এবং সাবধানতার সঙ্গে জীবনযাপন করলে দীর্ঘদিন পর্যন্ত প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব।
তবে হিমোফিলিয়া রোগীদের বিশেষ কিছু সাবধানতা মেনে চলতে হয়। শরীরে আঘাত লাগতে পারে এ রকম কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ না করা, পেশিতে ইনজেকশন না নেওয়া, যেকোনো ধরনের অস্ত্রোপচারের পর রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া, ব্যথানাশক ওষুধ বা রক্ত তরল করে এ রকম ওষুধ (যেমন এসপিরিন) না খাওয়া ইত্যাদি।