তাহমিদ লিয়াম:
টেস্ট থেকে ছিটকে গেছেন সেই ২০০৯ সালেই। ২০১৭ সালে বিদায় জানিয়ে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিকেও। এরপর শুধু ওয়ানডে ক্রিকেটেই খেলে গেছেন।
২০১৪ সালে খাদের কিনারা থেকে দলকে উদ্ধার এরপর ২০১৫ বিশ্বকাপে দলকে কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে যাওয়া, ঘরের মাঠে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয়, ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে কিংবা দেশের পুরুষদের ক্রিকেট ইতিহাসের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সাফল্য উইন্ডিজ ও আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজ জয়, এর সবকিছুই হয়েছে মাশরাফির অধিনায়কত্বে।
মাশরাফির আক্ষেপ হয়তো-বা দুইটাই। এক. ঘরের মাঠে ২০১১ বিশ্বকাপে খেলতে না পারা ও দুই. টানা দুইবার দলকে এশিয়া কাপের ফাইনালে নিয়ে গেলেও একবারও শিরোপা না ছুয়ে দেখা।
২০২৩ বিশ্বকাপে যে থাকছেন না সেটা জানিয়ে দিয়েছিলেন ২০১৯ বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগেই। তাই পুরো জাতি অপেক্ষায় ছিল মাশরাফির শেষ বিশ্বকাপটিতে বড় কোন অর্জনের। কিন্তু হায়! ভাগ্যের এ কেমন খেলা? নিজের শেষ বিশ্বকাপের ৮ ম্যাচে মাত্র ১ উইকেট ম্যাশের! আরও বড় আক্ষেপ ১০ দলের মধ্যে ৮ নম্বরে থেকে আসর শেষ করা৷
মাশরাফির শেষ মূলত সেখানেই দেখে ফেলেছিলেন অনেকে। ২০১৯ বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচটি নাকি মাশরাফি নিজেই চাচ্ছিলেন যেন বাংলাদেশের জার্সিতে তার শেষ ম্যাচ হোক। কিন্তু কোন এক কারণে শেষমেশ সেটা আর হয়নি।
এরপর বিশ্বকাপ শেষে শ্রীলঙ্কা সফরে ইঞ্জুরির কারণে জেতে পারলেন না৷ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঘরের মাঠে একটি ওয়ানডে আয়োজন করে বিসিবি মাশরাফিকে জমকালো এক বিদায় উপহার দিতে চাইলেও সেটাও মানা করে দেন নড়াইল এক্সপ্রেস। জল্পনাকল্পনা বাড়তে থাকে আরও। কবে ইতি টানবেন ম্যাশ?
এর মাঝে ২০১৯-২০২০ সালের বঙ্গবন্ধু বিপিএলে অধিনায়কত্ব করে ঢাকা প্লাটুনকে নিয়ে গেলেন প্লে-অফ পর্যন্ত৷ ২০২০ সালের মার্চে জানা গেল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজটিই হবে ‘অধিনায়ক’ হিসেবে মাশরাফির শেষ সিরিজ। সেই সিরিজ ৩-০ তে জিতে সতীর্থরা অধিনায়ক মাশরাফিকে ভালোই এক বিদায় উপহার দিলেন। তবুও প্রশ্ন থেকে যায় তখন। খেলোয়াড় মাশরাফি কবে ইতি টানবেন?
গত কয়েকদিন আগে বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপে ছিলেন না। তবে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপের শেষের দিকে জেমকন খুলনার হয়ে খেলে শিরোপা জেতাতে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একটি ম্যাচে তো আবার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো পেয়ে যান ৫ উইকেটও। আর তখনই আরও বেশী প্রশ্ন উঠে যায়। উইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে কি থাকছেন নড়াইল-২ আসনের এই সংসদ সদস্য?
আকরাম খান স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে টি-টোয়েন্টির পারফরম্যান্স দিয়ে ওয়ানডে দল বিবেচনা করা হবে না। আবার বিসিবি প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসানেরও কথায় আরও বেশী স্পষ্ট হয়ে যায় যে মাশরাফিকে নিয়ে আলাদা করে কোন পরিকল্পনা করছে না বিসিবিও।
অবশেষে আজ ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারী সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলো। উইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের জন্য ঘোষিত ২৪ সদস্যের প্রাথমিক দলে নাম নেই মাশরাফির৷ বলার অপেক্ষা রাখে না যে অন্যান্য দলগুলোর মতো বাংলাদেশও ২০২৩ বিশ্বকাপকে ঘিরে পরিকল্পনা সাজাতে ব্যস্ত। আর একারণে তরুণদের সুযোগ দেওয়া চাই৷ তাই এবার আর আবেগের বশবর্তী হয়ে মাশরাফিকে দলে রাখলেন না নির্বাচকরা।
২০০১ সালের ৮ নভেম্বর টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলা শুরু হওয়ার পর খেলেছেন মোট ৩৬ টেস্ট। বল হাতে তার ৭৮ উইকেট এখনো টেস্টে যেকোনো টাইগার পেসারের সর্বোচ্চ। সেরা বোলিং ৪/৬০। এছাড়া ৩ ফিফটিসহ মোট রান করেছেন ৭৯৭ সর্বোচ্চ ৭৯।
২০০১ সালের ২৩ নভেম্বর ওয়ানডে অভিষেক ঘটে তার এরপর খেলা ২২০ ওয়ানডেতে নিয়েছেন ২৭০ উইকেট, সেরা বোলিং ৬/২৬। ব্যাট হাতে মাত্র ১ ফিফটিসহ মোট রান ১,৭৮৭; সর্বোচ্চ ৫১*। এছাড়া এই ফরম্যাটে মাশরাফি তালুবন্দি করেছেন মোট ৬২টি ক্যাচও।
২০০৬ সালে বাংলাদেশের অভিষেক টি-টোয়েন্টি ম্যাচটি ছিল মাশরাফিরও টি-টোয়েন্টি অভিষেক। এরপর ২০১৭ সালের শ্রীলঙ্কা সফরে তৎকালীন হেডকোচ চন্দীকা হাতুরুসিংহের সাথে রাগারাগি করে অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত ৫৪ টি-টোয়েন্টি খেলে উইকেট ৪২টি; সেরা ৪/১৯। ব্যাট হাতে রান ৩৭৭; সর্বোচ্চ ৩৬৷
অধিনায়ক হিসেবে মাত্র ১ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন ম্যাশ এবং ঐ টেস্টেরই মাঝপথে ইঞ্জুরিতে পড়ে ছিটকে গেলে ছিটকে যান সাদা পোশাকের ফরম্যাট থেকেই। উইন্ডিজের বিপক্ষে সেই ম্যাচটি অবশ্য জিতেছিল টাইগাররাই। ২৮ টি-টোয়েন্টিতে কাপ্তানি করে দলকে জেতান ১০ ম্যাচে৷ এবং ওয়ানডেতে তার অধিনায়কত্বে খেলা ৮৮ ম্যাচে বাংলাদেশের জয় ৫০টি!
খেলোয়াড়ি জীবনে একবার দুইবার নয়, ইঞ্জুরির কবলে পড়ে মোট ১৩ বার অস্ত্রোপচার করাতে হয় মাশরাফির। আর প্রতিবারই তিনি ফিরে এসেছেন বীরের বেশে। খেলোয়াড় কিংবা অধিনায়ক মাশরাফির কোন অবদানই অস্বীকার করার সুযোগ কারো নেই৷
আজ না হয় কাল, একদিন না একদিন না এম্নেতেও থেমে যেতে হতো তাকে৷ আর আজকের এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যদি মাশরাফির থেমে যাওয়া নিশ্চিত হয়ে যায় তাহলে মাশরাফির ক্রিকেট পরবর্তী জীবনের জন্য রইলো শুভকামনা!
যতো যাইহোক না কেন, বাংলার ক্রিকেটে আরেকটা মাশরাফিকে পেতে আর কত বছর অপেক্ষা করতে হবে সেটা যেমন একটা প্রশ্ন, ঠিক তেমনই আদৌও মাশরাফির মতো অদূর ভবিষ্যতে কাউকে পাওয়া যাবে কি-না সেটাও একটা প্রশ্ন।