ছোট গরু নয় ছোটো গোরু!
রহিম উদ্দিন,
ছোট গরু কি বড়ো গোরু হয় না?
হয় তো! আমাদের গত বছরের ছোটো গরুটা এখন মোটাতাজা আস্ত একটা বড়ো গোরু হয়েছে! সাম্প্রতিক সময়ে ফেইসবুকে আমার বন্ধু তালিকার বহু সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে দুই লাইন প্রমিত বাংলা বানান বিধি অনুযায়ী লিখতে না পারা বন্ধুটিও অনেক মজার মজার স্ট্যাটাস লিখেছে। বাংলা একাডেমির মত একটা প্রতিষ্ঠানকে নিয়েও তারা মুখরোচক কথাবার্তা আকারে ইঙ্গিতে বলেছে। তাদের স্ট্যাটাস, যুক্তিতর্ক পাঠান্তে আমার কবি জসীম উদ্দিনের ‘ কবর ‘ কবিতার একটা লাইন মনে পড়ে গেল। লাইনটা এই যে, হাতেতে না মারিলেও মুখেতে মারিতো শত! (সামান্য এদিক সেদিক হতে পারে, ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি কাম্য।) ঠিক, প্রিয় ফেইসবুক বন্ধুরা বাংলা একাডেমিকে ঢাকায় গিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভষ্ম বা ভেঙে দিতে না পারলেও কথাবার্তায় ও যুক্তিতর্কে ইতোমধ্যে জাহান্নামের কঠিনতর শাস্তির মতো সহস্রাধিক বার ভেঙেছে আবার গড়েছে। কিন্তু কেন ভাই?
কারণ, বাংলা একাডেমি অনেক আগে পরিবর্তিত কিছু বানানকে বর্তমান সংস্করণে হালনাগাদ করেছে। এই হালনাগাদকৃত শব্দসমূহের সঠিক সংখ্যা ঠিক কত তা আমার জানা নেই। আর, সবকিছুই আমার জানতে হবে এমনও কথা নেই। না জানার মধ্যেও একটা শব্দ খুব করে জেনে গেলাম গোরু! কয়েকদিন যাবত ফেইসবুকে দেখলাম, কীভাবে যেন সেসব শব্দভাণ্ডার হতে রোজার ঈদের শেষে, কোরবানির ইদের আগে এসে ছোট গরু ও বড়ো গোরু নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েগেছে। এমতাবস্থায় আমাদের অবস্থা কী! হয়তো, পক্ষে-বিপক্ষে দুয়েকটা স্ট্যাটাস দিয়ে শেষ করছি। কেউ কেউ বাংলা একাডেমির কর্তাদের জাত উদ্ধার করতেও বাকি রাখছি না। আমজনতার এহেন অবস্থা দেখে অন্যদিকে বাংলা একাডেমির ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা! অথচ, সঠিক ও গ্রহণযোগ্য মতামত কিংবা সিদ্ধান্ত নিয়ে কেউ এগিয়ে এলো না। অবশ্যই কেউ কেউ বলেছেন, বাংলা ভাষার নিয়ম-কানুন এসব বাংলা একাডেমির কাজ,আমাদের নয়। যাক বাবা, এ যাত্রায় এ কথা দিয়ে বাঁচা গেলো! আসল কথা ভিন্ন!
বাংলা একাডেমি, বাংলা ভাষা ও বানানের প্রমিত নিয়ম এবং ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের ধারণা অত্যান্ত নড়ে-বড়ে! ফলে, আমরা ধরি মাছ না-ছুঁই পানি এ জাতীয় মন্তব্য করে দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। বাস্তবতা ছিলো, আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে যেমন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করেছি, তদ্রুপ সচেতনতা ও সম্মিলিত উদ্যোগে প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু, আমরা সেই, যা আছে তা নিয়ে সুখী! যে যখন যেভাবে পারছে নিজের প্রচার প্রসার করে যাচ্ছে। বাংলা একাডেমির কর্তাব্যক্তিরাও এর বাইরে না।
এই যে গোরু বানান নিয়ে যারা চিল্লাপাল্লা করলেন, তারা কেউ কি জানেন, বাংলা একাডেমি কবে কীভাবে প্রতিষ্ঠা হয়েছে? কেউ প্রমিত বানানের নিয়মগুলো জানেন? শুধুমাত্র আবুলের ছেলে বাবুলের টাইমলাইনে দেখলেন বাংলা একাডেমির অভিধানে গরু-কে-গোরু লিখছে; অমনি আপনিও গোরুর মত লাফালাফি শুরু করে দিয়েছেন। হ্যাঁ, আমি জানি, ঈদ এবং গরু আমাদের কাছে অতিপরিচিত এবং চাষাভুষার শব্দ! অর্থাৎ, একজন প্রান্তিক কৃষক এবং দিনমজুরও ন্যায় এসব শব্দ আমাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। তাই পরিবর্তন নিয়ে কথা উঠছে, কতকালের পুরোনো শব্দ, পরিবর্তনে না করলেই বা ক্ষতি কী? বাংলা একাডেমি এতদিন কী করেছে?
যাইহোক, আমি আর গরু কিংবা গোরু বানান নিয়ে ঠিক বেঠিকের দিকে যাচ্ছি না। আমাদের বাংলা ভাষার বানানের ও উচ্চারণের সামগ্রিক সমস্যা নিয়ে দুটো কথা বলেই শেষ করছি।
১। আমাদের বানান ভুলের অন্যতম কারণ,আমরা বানানবিধি কিংবা ভাষার ব্যাকরণ নিয়ে পড়াশোনা করলেও বাচিকতা কিংবা উচ্চারণবিধি নিয়ে তেমন একটা পড়াশোনা করি না।
২। আমাদের বানানবিভ্রাটের অন্যতম কারণ শব্দের বানান ও উচ্চারণের ভিন্নতা। যেমন, আমরা লিখি আত্মা ( আ+ত+ম+আ), অথচ পড়ি, আত্তা ( আ+ত+ত+আ), বিশ্ব ( ব+ই+শ+ব) কিন্তু পড়ি, ( ব+ই+শ+শ) ইত্যাদি।
৪। আমাদের বাংলা ভাষায় একাদিক বর্ণের উচ্চারণ ধ্বনি এক, আবার একই বর্ণের রয়েছে একাধিক উচ্চারণ। যেমম, শ,ষ,স এই তিনটা বর্ণের উচ্চারণ আমাদের কাছে, ‘ শ ‘ অন্যদিকে অ, এ এসব বর্ণের দুটো করে উচ্চারণ রয়েছে।
হ্যাঁ, বানান কিংবা উচ্চারণের এতো এতো সমস্যা হয়তো একদিনে একবছরে কাটিয়ে উঠা সম্ভব না; তবে সকলের সদিচ্ছা থাকলে একযুগে কাটিয়ে উঠা সম্ভব। তার জন্য আমাদের শুধুমাত্র একটা কাজ করতে হবে। এক. আমাদের দৈনিন্দন জীবনে সবাইকে সবত্র সতর্কতার সাথে ভাষার ব্যবহার করতে হবে। দুই. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের বাংলা শিক্ষকদের ভাষার বানান ও উচ্চারণ বিধিমালার উপর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যথেষ্ট যোগ্য করে শ্রেণি কক্ষে পাঠদান করাতে হবে। এখনই দেখার সময় , এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমি কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
রহিম উদ্দিন
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।