বৃহস্পতিবার, আগস্ট ১৪, ২০২৫

‘শুভ জন্মদিন ব্রেটলি’

আপডেট:

তাহমিদ লিয়াম,
অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ৫১ টেস্ট ক্যারিয়ারে ২০০ এবং ৫০ ওয়ানডেতে ৫৫ উইকেট শিকারী পেসার জেফ থম্পসন। তাকে মূলত ফাস্ট বোলিং দিয়ে প্রতিপক্ষের দূর্গ কাপিয়ে দেওয়ার জন্যই চিনতেন সবাই। জেফ অবসরে চলে যাওয়ার পর ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রায় ২ দশক অপেক্ষা করতে হয়েছিলো জেফ থম্পসনের মতোই আরও একজনকে খুঁজতে। ব্রেট লি’র অভিষেকের পর সেই অপেক্ষার অবসান ঘটে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটে।

ছোটবেলায় ভাই শেন লি-এর সাথে ক্রিকেট খেলতেন ব্রেট (অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের হয়ে ৪৫টি ওয়ানডেও খেলেছেন শেন লি)। এরপর স্থানীয় একটি দল ওক ফ্ল্যাটস র‍্যাটসের হয়ে খেলে শুরু করেন ক্রিকেট ক্যারিয়ার। তাছাড়া ক্যাম্পবেলটাউনের হয়ে ফার্স্ট-গ্রেড ক্রিকেটে খেলেছেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ার অনূর্ধ্ব-১৭ ও ১৯ দলের হয়ে নজরকাঁড়া কিছু পারফরম্যান্স তাকে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে শেফিল্ড শিল্ডে (অস্ট্রেলিয়ার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট লিগ) সুযোগ করে দেয়। সেখানে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে নেন ৩ উইকেট।

বিজ্ঞাপন

নিউ সাউথ ওয়েলসের পারফরম্যান্স মুগ্ধ করেছিল অজিদের তখনকার অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহকে৷ তাই খুব দ্রুতই ডাক পেয়ে যান জাতীয় দলে। প্রথমে বেশকিছু দিন সাইডবেঞ্চ গরম করার পর অবশেষে ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৯৯ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলা শুরু ব্রেট লির। অভিষেক ইনিংসেই ৫ উইকেট! এবং পুরো ম্যাচে ৭টি। ডেনিস লিলির পর দ্বিতীয় অজি পেসার হিসেবে টেস্ট অভিষেকে ৫ উইকেট শিকারের রেকর্ড সেটা। এরপরের বছরই পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক হয়ে যায় তার৷

অভিষেকের পর পরবর্তী একটি বছর অর্থাৎ ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলেছিলেন মাত্র ৭টি ম্যাচ। এবং সেই ৭ ম্যাচে ৪২ উইকেট শিকার করেন লি। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ৭ ম্যাচ খেলে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ড এটা!

বিজ্ঞাপন

এবং সেই পারফরম্যান্সের কারণেই ২০০০ সালে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রথমবারের মতো চালু করা ‘ডন ব্র‍্যাডম্যান ইয়াং প্লেয়ার অব দা ইয়ার’-এর পুরস্কারও জেতা হয়ে যায় ব্রেট লির৷ এছাড়াও উইসডেন ক্রিকেট তাকে ১৯৯৯-২০০০ সালের ইয়াং ক্রিকেটার অব দা ইয়ারেরও পুরুষ্কার দেয়।

২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে প্রথমবারের বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েই সে আসরের ২য় সর্বোচ্চ ২২টি উইকেট শিকার করেছিলেন ব্রেট লি। যার মধ্যে কেনিয়ার বিপক্ষে সুপার সিক্সের ম্যাচে আছে হ্যাটট্রিকও।

১৫০ এর আশেপাশে নিয়মিতই অনায়াসেই বল ছুড়তে পারতেন লি৷ কিন্তু এতো জোরে বল ছুড়তে গিয়ে অনেকবারই ইঞ্জুরিতে পড়তে হয়েছে তাকে৷ ২০০৫ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একটি ম্যাচে ঘন্টায় ১৬১.১ কি.মি এর একটি বল ছুড়েছিলেন এবং এটিই তার ক্যারিয়ারে ছোড়া সবচেয়ে জোরে বল।

২০০৫ ও ২০০৬ সালে আইসিসি অ্যায়ার্ডসের পাশাপাশি সেবছরের বর্ষসেরা ওয়ানডে দলেও জায়গা হয় তার। এছাড়া ২০০৬ সালে আবারও উইসডেন ক্রিকেটার অব দা ইয়ারের পুরস্কার পান।

অজি গ্রেট গ্লেন ম্যাকগ্রা এবং শেন ওয়ার্নের অবসরে চলে যাওয়ায় অজিদের বোলিং ইউনিটের দ্বায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে ততোদিনে অনেক অভিজ্ঞ হয়ে যাওয়া ব্রেটের কাধের ওপর। তবে এই পথে ইঞ্জুরিতেও পড়েছিলেন বেশ কয়েকবার। প্রতিবারই অবশ্য ইঞ্জুরিকে জয় করে দূর্দান্ত প্রত্যাবর্তন করেছেন।

প্রথম বোলার হিসেবে লর্ডসে একাধিকবার ওয়ানডেতে ৫ উইকেট শিকারী বোলারের নাম ব্রেট লি।

এছাড়াও ২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইতিহাসের প্রথম বোলার হিসেবে শর্টার ফরম্যাটে হ্যাটট্রিক পেয়ে যান লি! গ্রুপ পর্বের সেই ম্যাচে প্রতিপক্ষ ছিল বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ার জেতা সেই ম্যাচটির ম্যাচসেরার পুরুষ্কারও উঠেছিল তার হাতে।

২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার বর্ষসেরা টেস্ট খেলোয়াড়ের পুরুস্কার জেতেন তিনি। ঐ বছর আবারও আইসিসি তাকে বর্ষসেরা ওয়ানডে ও টেস্ট দলে রাখে। ২০০৯ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগ টি-টোয়েন্টির টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কারও জেতেন এই ডানহাতি ফাস্ট বোলার।

২০০৮ সালে আবারও ভয়াবহ এক ইঞ্জুরিতে পড়ে যান লি। এবং অবশেষে ৩৪ বছর বয়সে ২০১০ সালে সাদা পোশাকের ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়ে দেন তিনি। ২০০৮ সালে ডিসেম্বর মাসে ডিসেম্বর মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচটিই তার খেলা বেগিগ্রিনে খেলা শেষ টেস্ট। কাকতালীয় ভাবে অভিষেক টেস্টের মতো শেষ টেস্ট ম্যাচটিও তিনি খেলছিলেন ডিসেম্বরের ২৬ তারিখ!

এর আগে ৭৬টি টেস্ট খেলে ৩১০টি উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি। নামের পাশে আছে ১০ বার ইনিংসে ৫ উইকেট তুলে নেওয়ার রেকর্ড। সেরা বোলিং ফিগার ৫/৩০। টেস্টে মাত্র ২য় অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে ৩৫০ উইকেট শিকারী বোলারের নাম ব্রেট লি। ব্যাট হাতে ৫টি ফিফটিসহ রান করেছেন ১,৪৫১৷

ওয়ানডে ক্রিকেটে অজিদের হয়ে তার সময়ে দ্রুততম ১০০ উইকেট শিকারের (৫৫ ম্যাচে) রেকর্ড ছিল লির দখলে। এরপর ৫২ ম্যাচে ১০০ উইকেট নিয়ে সেই রেকর্ড ভাঙ্গেন মিচেল স্টার্ক।

২০১১ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়া অস্ট্রেলিয়া দলের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলারও ছিলেন লি! ভারতের বিপক্ষে হেরে ২০০৩ ও ২০০৭ এর পর টানা ৩য় বারের মতো অজিদের ক্রিকেট বিশ্বকাপের ট্রফি ছুয়ে দেখার স্বপ্ন ভঙ্গের আগ পর্যন্ত নিয়েছেন মোট ১৩টি উইকেট। সেমিফাইনাল ম্যাচে ফিল্ডিংয়ের সময় বলের আঘাতে মাথা ফেটে রক্ত ঝড়ে তার। কিন্তু ব্যান্ডেজ লাগিয়ে খেলে যান পুরো ম্যাচ।

এরপর ২০১২ সালের জুলাই মাসে হঠাৎই শুনলাম তরুণদের সুযোগ দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায়ের ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন ব্রেট লি। অন্যতম প্রিয় এই বোলারের ওমন হুট করেই অবসরের ঘোষণায় খুবই কষ্ট পাই। যদিও বয়সের কারণে এর অনেক আগে থেকেই ডগ বলিঞ্জার, জন হ্যাস্টিংস, শন টেইট কিংবা মিচেল জনসনদের মতো বোলারদের সাথে তার দলে থাকার একটি প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছিল পরবর্তীতে এই তালিকায় যুক্ত হয় প্যাট কামিন্স, মিচেল স্টার্কদের নাম।

তার অবসরের পর মনে হলো ৪০০ উইকেট নেওয়ার পরও তো অবসর নিতে পারতেন কেননা ওয়ানডেতে ৪০০ উইকেট থেকে আর মাত্র ২০ উইকেট দূরে ছিলেন ‘বিঙ্গা’। আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ২২১ ম্যাচ খেলে মোট উইকেট নিয়েছেন ৩৮০টি৷ ম্যাচে ৫ উইকেট ৯ বার এবং সেরা বোলিং ফিগার ৫/২২। লোয়ারঅর্ডারে ব্যাট হাতে ৩টি ফিফটিসহ ১,১৭৬ রানও করেছেন তিনি।

২০০৫ সালে ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে অভিষেক হয়েছিল ব্রেটের। এরপর মাত্র ২৫ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে উইকেট আছে ২৮টি। ২০১২ সালের মার্চে সবশেষ টি-টোয়েন্টি এবং জুলাইয়ে সবশেষ ওয়ানডে খেলেন লি।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সব ধরনের ফরম্যাট মিলিয়ে মোট ৭১৮টি উইকেট আছে তার নামের পাশে। এই ৭১৮ উইকেট নিয়েই অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের ৩য় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার ব্রেট লি।

এছাড়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১১৬ ম্যাচে ৪৮৭ উইকেট শিকার করেছেন সিডনি সিক্সার্স ও কলকাতা নাইট রাইডার্সের সাবেক এই তারকা পেসার। ২০১৫ বিগ ব্যাশে সিডনি সিক্সার্সের হয়ে পার্থ স্কর্চার্সের বিপক্ষে খেলা ম্যাচটিই ছিল তার সবশেষ ক্রিকেট ম্যাচ।

ক্রিকেট ছাড়ার পর কমেন্ট্রিবক্সে কাজ করছেন। এছাড়াও এর বাইরে তার আরও পরিচয় আছে। ‘সিক্স অ্যান্ড আউট’ নামের একটি রক ব্যান্ডের সদস্য তিনি ও তার ভাই শেন লি। এছাড়া ভারতে সুবিধাবঞ্চিত সঙ্গীতপ্রেমীদের কল্যাণে Mewsic নামের একটি ফাউন্ডেশন গড়েছেন তিনি। ২০১৬ সালে ‘আনইন্ডিয়ান’ নামের একটি ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান ছবিতে অভিনয়ও করেছেন ব্রেট।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে দাবানলে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য সাবেক ক্রিকেটারদের নিয়ে ‘দি বিগ আপিল’ নামের একটি চ্যারিটি ম্যাচ আয়োজন করে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। সেখানে লিকে দেখে মনেই হয়নি যে ৮ বছর আগে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নিয়েছেন। দেখে মনে হলো এখনো যেন সেই আগের টগবগে লি!

আধুনিক যুগের ক্রিকেটের অন্যতম এই আগ্রাসী এবং দ্রুতগতির বোলার ব্রেট লি ওরফে বিঙ্গা ১৯৭৬ সালের ৮ নভেম্বর নিউ সাউথ ওয়েলসের উলুংগংয়ে জন্মগ্রহণ করেন।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ:

সর্বাধিক পঠিত