এম এ সাত্তার, কক্সবাজার
* এনজিওরা মানেনি সরকারি নির্দেশনা।
* লকডাউনে থেমে নেই এনজিওর কিস্তি।
* এনজিওর গ্যাড়াকলে খেটে খাওয়া মানুষ।
* লকডাউনে কিস্তি আদায়, কর্মহীন মানুষের ভোগান্তি।
* কিস্তি আদায়ে গ্রাহকের বাড়িতে ব্র্যাক কর্মীর হানা।
* কিস্তি ওয়ালাদের চাপে দিশেহারা নিম্নআয়ের মানুষ।
কঠোর লক ডাউনেও থেমে নেই এনজিওর কিস্তি আদায়। কিস্তি ওয়ালাদের চাপে দিশেহারা হয়ে পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষ। কিস্তির টাকা পরিশোধ না করলে গ্রাহকের বাড়িতে হানা দিয়ে নাজেহাল করছে এনজিওকর্মীরা।
লকডাউন এর পিরিয়ড চলাকালীন সময়েই দেশে কর্মরত এনজিও গুলোকে ঋনের কিস্তির টাকা উত্তোলন না করতে পরিপত্র জারি করেছে সরকার। বিশেষত্ব ঋন প্রোগ্রাম পরিচালিত এনজিও গুলোকে লকডাউন সময়ে কোন ঋণগ্রস্তদের কাছ থেকে জোরপূর্বক কিস্তির টাকা সংগ্রহ না করার জন্য প্রশাসন কঠোর নির্দেশনা দিলেও কোন এনজিও সংস্থা মানেননি প্রশাসনের ওই নির্দেশ। এনজিওকর্মীরা ঋণগ্রস্ত গ্রাহকদের বিভিন্ন ভয়-ভীতি প্রদর্শন অব্যাহত রেখে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ঋনের কিস্তির টাকা আদায়ে ব্যতিব্যস্ত রয়েছেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কিস্তির টাকা আদায় ও বিতরণ করে যাচ্ছে তারা। কোন মাসের কিস্তি ওডি রাখাতো দুর কথা, কোন সদস্য ঋণ গ্রহণের তারিখ অনুসারে কিস্তির টাকা পরিশোধ না করলে এনজিওকর্মীরা ঋণ গ্রহীতার বাড়িতে গিয়ে পরিবারের অন্যলোকজনের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি মহিলাদের সাথে খারাপ বিহেভ করছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
কক্সবাজার সদর পিএমখালী ইউনিয়নের চেরাংঘর বাজারের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী বখতিয়ার উদ্দিন জানান, টাকার বিশেষ প্রয়োজনবশত দেশের বৃহৎ এনজিও সংস্থা ব্র্যাক বি জি বি ক্যাম্প রিজওনাল অফিসে প্রগতি প্রোগ্রামের ঋন কর্মকর্তা মনির এর সাথে কথা বলেন সে। তার সাজেকশন অনুসারে ব্যাংকের ব্ল্যাংক চেক, জমির দলিল-খতিয়ান জামানত, গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে জামিনদার ও সাক্ষীসহ স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর দিয়ে পাসপোর্ট ভিসার বিপরীতে প্রবাসী কল্যাণ প্রকল্পের আওতায় ১৮ মাস মিয়াদি ৪ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে গমন করেন তার এক নিকটাত্মীয়।
ঋণগ্রহীতার (সম্পর্কে ভাইপুত্র) অবর্তমানে সবকিছু দেখাশোনা করেন সে। এমনকি ঋণ নেওয়ার পর থেকে কোন মাসের কিস্তি অনাদায়ী তো দুর কথা, লোন নেওয়ার তারিখ থেকে ২৭ হাজার ২০০ টাকা প্রতি মাসে কিস্তি আদায় করেছেন সে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার কারণে সরকার লকডাউন ঘোষণা করলে ব্যবসা-বাণিজ্যের আয়-উন্নতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। শুধু এই দেশ নয়, বাইরের কান্ট্রিতে প্রবাসীদের জীবনমান স্থবির হয়ে তাদের মধ্যে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। সবকিছুই অদৃশ্য শুন্য হয়ে একপ্রকার মানবেতর জীবনযাপন করছেন সবাই।
তিনি বলেন, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে ব্যবসা-বাণিজ্যে বন্ধ হয়ে কোন খাত থেকে সাপোর্টিং না পেলেও ঋণ পরিশোধের ইচ্ছায় ধারদেনা করে কিস্তির টাকা আদায় করে যাচ্ছেন। ইত্যবসরে কঠোর লকডাউনের কারণে সিএনজি, ইজিবাইক চলাচল বন্ধ রাখতে হয়, অন্যদিকে পবিত্র কুরবানী ঈদের মোটা খরচের কারণে চলিত মাসের কিস্তির টাকা ৫ তারিখের ভিতর দিতে পারেননি। যার কারণে ঋণ কর্মকর্তা মনিরুল এর কাছে ক্ষমা চেয়ে কয়েক দিনের ভিতরে টাকা পরিশোধ করবে বলে অঙ্গীকার করেন।”চোর শোনে না ধর্মের কাহিনী” ওই ‘নাছোড়বান্দা’ তাকে নির্দিষ্ট তারিখের ভিতরে টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে সাফ জানিয়ে দেয়। এরপর কিস্তির টাকা পরিশোধ করার জন্য প্রতিদিন একাধিকবার বিরক্তিকর ফোন কলের মাধ্যমে নানান ভয়-ভীতি তো দিচ্ছেই, আবার থানা কোর্টে চেক ডিজঅনার মামলা ঢুকে দেওয়ার হুমকি।
চলিত সপ্তাহে টাকা পরিশোধ করার চেষ্টা করবেন বলে তাকে আশ্বস্ত করলেও ৫ তারিখে কিস্তির টাকা না পেয়ে মনির আমার চেরাংঘর বাজারের প্রতিষ্ঠান এড়িয়ে ছনখোলা এলাকায় ঋনির বাড়িতে গিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি মহিলাদের সাথে খারাপ বিহেভ করতে দ্বিধা করেনি সে।
জানা যায়, চলমান লকডাউনের ফলে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের ঋণগ্রহীতারা। ঋণের কিস্তি দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। ছোটখাটো বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে তাদের ব্যবসার কার্যক্রম চালান। এ ছাড়াও অনেকে এনজিও থেকে কিস্তিতে ঋণ নিয়ে সিএনজি, ইজিবাইক, থ্রিহুইলার, ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহন কিনে চালিয়ে তা থেকে আয় করে জীবিকা নির্বাহ করেন ও ঋণের কিস্তি দেন।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচলের সরকারি নির্দেশনা থাকলেও সরেজমিনে দেখা যায় এনজিওকর্মীরা ঋণগ্রহীতাদের বাসাবাড়ি গিয়ে কিস্তির টাকা আদায় করছেন। কোনো এনজিওরকর্মী এক বাড়িতে টেবিল চেয়ার নিয়ে বসে সমিতির সকল ঋণগ্রহীতা সদস্যদের নিকট থেকে কিস্তি আদায় করছেন। এ সময় তাদের মাঝে মাস্ক ব্যবহার বা সামাজিক দূরত্ব মানার কোনো বালাই দেখা যায়নি।
ছনখোলা গ্রামের এক খামারি জানান, সে গত ছয়-সাত মাস আগে এনজিও ‘আশা’র এসএমই শাখা থেকে ১৮ মাস মেয়াদী ৩ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এতে প্রতিমাসে ২২ হাজার প্লাস টাকা কিস্তি দিতে হয়। দুধ বিক্রি করে অন্যান্য খরচ মিটিয়ে আর প্রতিদিন কিছু জমিয়ে মাসিক কিস্তি দেই। লকডাউনের কারণে পানির দামেও দুধ বিক্রি করতে পারছেনা। ধারদেনা করে গোখাদ্যের প্রয়োজন মেটাতে হচ্ছে তার। শ্রমিকের বেতন বাকি চার পাঁচ মাস ধরে।
এরমধ্যে কিস্তিওয়ালার চাপ। নির্দিষ্ট তারিখে কিস্তি পরিশোধ না করলে ঘরে বাইরে থাকা যায়না, ফোনের উপর ফোন। এ যেন অসহ্য নরক যন্ত্রণা। পাশাপাশি সমানতালে বারবার ফোন দিয়ে বিরক্ত করেন লোনের জামিনদারসহ সাক্ষীদেরও। সরকারি আদেশ নিষেধ মানার কোনো বালাই নেই এনজিওদের। এসব বিষয় তাদের আলোকপাত করা হলে সরকারের ইতিকথার কোন নীতি নেই বলে মন্তব্য করে তাদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা পরিশোধ করে পরবর্তীতে সরকার থেকে টাকা নেওয়ার পরামর্শ দেয়। দেশে কঠোর লকডাউন চললেও কোন মাসের কিস্তির টাকা ওডি রাখা সম্ভব হইনি। হন্য হয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রতি মাসের কিস্তির টাকা।এনজিওর এমন নীতি গর্হিত কাজের প্রতি নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।
এনজিও আশার মাঠকর্মী হেদায়েত উল্লাহ গ্রাহকের কাছ থেকে লকডাউন এ কিস্তির টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, পরিপত্র অনুসারে সে কিস্তির টাকা আদায় করে যাচ্ছেন। কোন গ্রাহক কিস্তির টাকা পরিশোধে বিলম্ব করলে লোনীর জামিনদারকে প্রতিমাসে মোবাইল কলের মাধ্যমে বিরক্ত করার গুরুতর অভিযোগও রয়েছে উক্ত এনজিও আশা’র কর্মির বিরুদ্ধে।
ব্রাকের প্রগতি প্রোগ্রামের মাঠকর্মী মনির বলেন, এক গ্রাহকের সাথে সামান্য ভুলবোঝাবুঝি হয়েছে মাত্র। তাদের অফিসের কার্যক্রম পূর্বে যেমন ছিল তেমনি আছে। লকডাউনে তাদের কাজের কোনো প্রভাব পড়েনি আর কোন সময় অফিসও বন্ধ হয়নি। কোন বাধা বিপত্তি ছাড়াই পুরোদমে লোন বিতরণ ও আদায়ের কাজ চালু রয়েছে। বিজিবি ক্যাম্প অফিসে গিয়ে ঊর্ধ্বতন কারও সাথে কথা বলতে পরামর্শ দেয়।
গ্রাহকের সাথে খারাপ ব্যবহার করে নাজেহাল করার বিষয়ে ব্র্যাক প্রগতি প্রোগ্রামের এলাকা ব্যবস্থাপক সাধন কুমার দাসের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে জানান, এ সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু জানেন না, কেউ জানাইনি। অভিযোগকারী গ্রাহকের সাথে গতকাল দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে এসময়ও তাকে সে কিছু জানাইনি বলে প্রতিবেদককে বলেন।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন রায় বলেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নিবেন।