এম এ সাত্তার, কক্সবাজার:
কক্সবাজারে বনকর্মীরা ভুলে গেছেন তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তারা থাকলেও নেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে রেঞ্জ অফিস সমূহে।বনের জমি অবৈধদখল ও পাহাড় কাটার কর্মযজ্ঞ চললেও দায়িত্বশীল কেউ নেই এসব দেখার। প্রশাসনকে পকেটস্থ করে প্রাকৃতির ওপর ভুমিদস্যুরা প্রকাশ্য ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে বলে এমন অভিযোগ স্থানিয়দের।
বিভিন্ন রেঞ্জ বনবিট এলাকায় নানা কৌশলে বনভূমি দখল বাণিজ্য অব্যাহত রয়েছে। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর সবুজের সমারোহ ধ্বংস করে সংরক্ষিত বনভূমিতে স্থায়ী বসতবাড়ি ও দখল বানিজ্য চললেও বন সম্পদ রক্ষার দায়িত্বরত কর্তৃপক্ষের আইনগত কোন ব্যবস্থা নেই। সুযোগ পেয়ে কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী মূল্যবান বনভূমি বেহাত করে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা।
ইতিপূর্বে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও কোন তৎপরতা নেই প্রশাসন তথা সংশ্লিষ্ট পরিবেশ ও বন বিভাগের। ২/১টি প্রতিবেদনের তদন্ত হলেও বন্ধ হচ্ছে না বনভূমিতে ঘরবাড়ি নির্মাণ ও দখল বাণিজ্য।
সরেজমিনে জানা যায়, পিএমখালী রেঞ্জের দিঘীর ঘোনা বনবিটের পশ্চিমে আনুমানিক একশত গজ দূরত্ব সীমানার মধ্যে সড়ক সংলগ্ন (উত্তর দক্ষিণ পাশে) সুলতানের ঘোনায় সামাজিক বনায়ন নিধন করে জবরদখল নিয়ে ইতিমধ্যে কাঁচাপাকা অর্ধশত ঘর নির্মাণ করেছে ভূমিদস্যুরা।
ছনখোলা নয়াপাড়া এলাকার সিএস ৫৯৮ নং দাগের জমি বন বিভাগের নামে গেজেটভুক্ত। ২০১০ সালে থানা পুলিশের একটি দল, ম্যাজিস্ট্রেট, বন কর্মীদের উপস্থিতিতে আগর বাগান সৃজন প্রকল্পের আওতাধীন সামাজিক বনায়নের জন্য নির্ধারিত জমিতে চারা রোপণ ও অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করতে গিয়ে ভূমিদস্যুদের কর্তৃক আহত হয়েছিলেন একাধিক উপকারভোগী সদস্য। এ নিয়ে আদালতে ২টি মামলাও বিচারাধীন রয়েছে।
সেখানে রেজিস্টার কৃত জমির মালিকের দখলে থাকা পিএফল্যান্ড কিনে তিন তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে এক সীমানার মধ্যে ভবন নির্মাণ করেন মৃত আব্দুল হাকিমের পুত্র ছৈয়দ আলম ও মালয়েশিয়া প্রবাসী জনৈক এক বার্মায়া নাগরিক। ভবনের এক তলার কাজ সম্পন্ন করে বসবাস শুরু করেছে তারা।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার বার্তায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে স্থানীয় বিট কর্মকর্তা সরেজমিন গিয়ে যোগাযোগ করে বিট অফিস, হাটবাজারে ডেকে নিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা নেন না স্থানীয় বিট কর্মকর্তা, অভিযোগ সচেতন মহলের।
উক্ত ভবনদ্বয়ের দক্ষিণ পাশে বনের জমিতে পাকা, সেমি পাকা, কাঁচা অর্ধশত ঘর তৈরি করেছে প্রবাসী ইমাম হোসেনসহ অসংখ্য অবৈধ দখলদার। তারা একদিকে বনের জমিতে ঘর তৈরি করে অবৈধ বসবাস করছে। পাশাপাশি তাদের বাড়ির লাগোয়া পাহাড় কেটে সাবাড় করেছে।
একটি সূত্র জানায়, বনভূমিতে পাকা বাড়ি, দখল, পাহাড় কাটার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে মৌখিক অভিযোগ করেছেন একাধিক ব্যক্তি। বিট/রেঞ্জের দায়িত্বরত কর্মীদের রহস্যময় ভূমিকা নিয়ে সচেতন মহলের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সেইসাথে নীরব রয়েছে বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অফিস।
পিএমখালীর সমাজকর্মী মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ জানান, ডিমারকেশন ছাড়া স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ নেই। বনভূমিতে ভবন নির্মাণে জড়িতদের কারও যৌথ ডিমারকেশন নেই। বিট অফিস ম্যানেজ না করে ভবন তো দূরের কথা, ছোট কিছুও করা যায় না।
আবার একই এলাকায় রাস্তার পশ্চিম পাশে তিন তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত আলীশান ভবন নির্মাণ করছেন মৃত আবুবক্করের পুত্র সৌদি প্রবাসী সিরাজ উল্লাহ।
তাদের বাড়ির পশ্চিমে সামাজিক বনায়ন উজাড় করে বনভূমির বিশাল জমি দখল করে রেখেছে তার ভাইয়েরা। সেখানে পূর্ব থেকে একাধিক বাড়ি নির্মাণ করেন তারা। গত কিছুদিন আগে বনায়নের শতশত গাছ কেটে বিক্রি করে দিয়েছে উক্ত দখদারেরা। এ ব্যাপারে রেঞ্জ কর্মকর্তাকে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেননি।
তাদের দখল করা বনায়নের ওই জমিতে কক্সবাজারে বসবাসরত ভূমিহীনদের জমি দেয়ার জন্য কক্সবাজার পৌরসভার কাউন্সিলর নুর মোহাম্মদ ও সার্বিয়ার সুমনের নেতৃত্বে জমিটি পরিমাপ করতে আসলে তাদের সাথে আঁতাত করে মোটা অংকের টাকা মেরে তাদের দখল আরো পাকাপোক্ত করেন। এরপর চারিপাশে কাটা শিকল দিয়ে ঘিরে একাধিক ঘর বেঁধে রাখেন ওসমান গ্যাং।
ছনখোলা মালিপাড়ার ইউনুছ ঘোনার দক্ষিনে হাজী পুতুন আলী ছেলেদের কাছ থেকে ২০ শতক বনভূমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করেছেন জাহাঙ্গীর আলম। তার লাগোয়া (পশ্চিমে) ৩০ শতক বনভূমি কিনে মুরগির ফার্ম নির্মাণ করেছেন সিরাজুল্লাহ প্রকাশ বাঁশি। তাদের পশ্চিম পাশে প্রায় বিশ শতক বনভূমিতে দ্বিতল আলিশান বাড়ি করেছেন অলি আহমদের মেয়ে ইয়াবা সম্রাজ্ঞী জেসমিন আক্তার।
এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি, স্থায়ী ঘর, ফার্মসেট নির্মাণ, বন দখল বিক্রি, বনভূমিতে স্থায়ী সীমানা প্রাচীর দিয়ে
দখল, বিক্রি প্রকাশ্যে চললেও বিট ও রেঞ্জ অফিসের কর্তাবাবুরা কোন বাধা নিষেধ দিচ্ছেন বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।
বনের জমিতে অবৈধ স্থাপনাগুলোর মধ্যে বেশির ভাগের কাজ সাবেক বিট ও রেঞ্জ কর্মকর্তার আমলে শুরু হয়। দখল, বেচাবিক্রির কাজ এখন বিদ্যুৎ গতিতে চলছে। বর্তমান বিট কর্মকর্তা মোশাররফ ও রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল জব্বারের সাথে গভীর সখ্যতা গড়ে তোলে মাসোহারা ও নগদে বন দখল, বিক্রি, পাহাড়কাটা মাটি বালি, কাঠ বিক্রি করে দিচ্ছেন বনখেকোরা।
সরেজমিন দেখা যায় স্থানীয় চেরাংঘর বাজারে বিট কর্মকর্তা মোশারফ এক বনখেকোর (যার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই একাধিক বনের জমি বিক্রি করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে) কাছ থেকে টাকা নিতে দেখা যায়। দৃশ্য প্রতিবেদকের পরিলক্ষিত হলে বিট কর্মকর্তাকে জনৈক ব্যক্তির কাছ থেকে কিসের টাকা নিয়েছেন জিজ্ঞাসা করা হলে সে জানায়, ওই লোকটি বনের জমিতে চারা রোপণ করবে তাই চা খাওয়ার জন্য আমাদের কিছু টাকা দিয়েছেন।
বন বানিজ্যের অভিযোগের এ ব্যাপারে রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল জাব্বার বলেন, তার রেঞ্জ জনবলের সংকট রয়েছে তাই সে চাইলেও বনখেকোদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারে না। আর ঢালাওভাবে যে ঘরবাড়িগুলো তোলা হয়েছে এসব ব্যাপারে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সবাই জানেন। এখানে তার কিছু করার নেই। তারপরও বিট ও রেঞ্জে অফিসে পর্যাপ্ত জনবল পাওয়া গেলে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ পুর্বক জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি।