শনিবার, আগস্ট ১৬, ২০২৫

এখন সময় ব্যাডমিন্টনের!

আপডেট:

ইসমাঈল হোসেন, রাঙ্গুনিয়া:
পশ্চিমাকাশে সূর্য অস্ত গিয়ে রাত নেমে আসতে না আসতেই দূর থেকে শব্দ ভেসে আসছে। একটু কাছে যেতেই শব্দ আরও জোরালো হলো। ‘স্ম্যাশ, নো…সার্ভিস লস্ট, সাইড চেঞ্জ, গেম বল…’ কোর্ট থেকে ভেসে আসছে চিৎকার। খেলায় টানটান উত্তেজনা। দু’পাশে বাঁশের সঙ্গে বোর্ড ঝুলিয়ে লাগানো হয়েছে ডজনখানেক লাইট। সেই আলোর ঝলকানিতে র‌্যাকেট আর কর্কের ঠাসঠাস শব্দ। চারদিকে র‌্যাকেট হাতে অপেক্ষমাণ খেলোয়াড়, ছোট-বড় অনেক দর্শকের মধ্যেও তুমুল উত্তেজনা। সিরাজগন্জের এনায়েতপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে গেলে চোখে পড়বে ব্যাডমিন্টন খেলার এমন চিত্র। শুধু এখানে নয়, রাজধানীসহ দেশের বেশিরভাগ এলাকাই এখন ব্যাডমিন্টন খেলায় সরগরম। শীতের শুরু থেকেই ধুম পড়ে এ দেশে মৌসুমি খেলা হিসেবে পরিচিত ব্যাডমিন্টনের।

শীত মানেই ব্যাডমিন্টন। শীতের রাতে চাঙ্গা হতে তারুণ্যের আশ্রয়। আড্ডা, সময় কাটানো বা শুধুই হুল্লোড়। ব্যাডমিন্টন ছাড়া যেন শীত জমেই না আজকাল। শীত এলেই তরুণদের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় ব্যাডমিন্টন খেলার। গ্রাম কিংবা শহর সবখানেই হিড়িক পড়ে যায় খেলাটির। গ্রামে বড় মাঠেই কোর্ট কেটে শুরু হয় খেলা। কিন্তু শহরে তো তেমন মাঠই নেই। তাতে কি! খেলা তো আর বন্ধ হতে পারে না। তাই পাড়ায় পাড়ায় ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্ট কেটে ছেলেমেয়ে, তরুণ, বৃদ্ধ সবাই নেমে পড়ে খেলায়। যেহেতু মাঠের অভাব, তাই রাস্তার মাঝে বা গলির রাস্তায় কোর্ট কেটে চলে খেলার মহোৎসব। খেলাটির আয়োজনে মূল ভূমিকা পালন করে সাধারণত পাড়ার তরুণরাই। নিজেরাই চাঁদা দিয়ে অথবা চাঁদা উঠিয়ে খুব ধুমধাম করে আয়োজন করে ব্যাডমিন্টন খেলার। এ ক্ষেত্রে সাড়া দেয় এলাকার লোকজনও। চাঁদা দেওয়ার ব্যাপারে থাকে না তেমন কার্পণ্য। কারণ ব্যাডমিন্টন খেলার প্রতি প্রত্যেকেরই রয়েছে অপার ভালোবাসা। এটি এমন এক খেলা, যা খেলতে পছন্দ করে সবাই। ফলে সন্ধ্যা হলেই ভিড় জমে খেলার কোটের সামনে।এক সঙ্গে এক খেলায় চারজনের বেশি খেলতে পারে না বলে অধিকাংশকেই কোটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অপেক্ষা করতে করতেই এক কোর্টের পাশে তৈরি হয় আরও বেশ কয়েকটি ব্যাডমিন্টন কোর্ট। প্রায়ই দেখা যায় এক কাতারে লাইন ধরে চার-পাঁচটি কোর্ট কাটা হয়েছে। সন্ধ্যার পর খেলা শুরু হয় বলে আলোর প্রয়োজন আবশ্যক। আলোর ব্যবস্থা করতেই পাঁচশ-হাজার ওয়াটের বাল্ব লাগানো হয় কোর্টের পাশে। কেউ কেউ হ্যাজাক লাইটও লাগান। ব্যাডমিন্টন খেলার খরচ খুব বেশি একটা না হলেও কমও নয়। পুরো খরচটাই এলাকার তরুণরা কোনো একভাবে ব্যবস্থা করে ফেলে। খেলার নিয়ম-কানুন:

বিজ্ঞাপন

ব্যাডমিন্টনের কোর্ট : ব্যাডমিন্টনের কোর্ট সমতল আয়তাকৃতির হয়ে থাকে। একক ও দ্বৈত উভয়ক্ষেত্রে যার দৈর্ঘ্য ১৩.৪ মিটার [৪৪ ফুট]। প্রস্থের মাপ বাড়ে দ্বৈতের ক্ষেত্রে। দ্বৈত কোর্টের প্রস্থ ৬.১ মিটার (২০ ফুট), এককে ৫.১৮ মিটার (১৭ ফুট)। নেটের উচ্চতা ১.৫৫ মিটার [পাঁচ ফুট এক ইঞ্চি]।র‌্যাকেট/ব্যাট : বিডবি্লউএফ [ব্যাডমিন্টন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন] কর্তৃক নির্ধারিত কিছু মাপ রয়েছে যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এই মাপ অনুযায়ী বিভিন্ন র‌্যাকেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে র‌্যাকেট উৎপাদন করে থাকে।একটি র‌্যাকেটের দৈর্ঘ্য সর্বাধিক ৬৮ সেন্টিমিটারের বেশি হবে না এবং প্রস্থ ২৩ সেন্টিমিটারের বেশি হবে না। জাল বোনা মাথার দৈর্ঘ্য সর্বাধিক ২৮ সেন্টিমিটারের বেশি হবে না এবং জাল বোনা মাথার প্রস্থ সর্বাধিক ২২ সেন্টিমিটারের বেশি হবে না। তবে বাস্তব ক্ষেত্রে আধুনিক র‌্যাকেটগুলোর মাপ সর্বোচ্চ মাপের তুলনায় কিছুটা ছোট হয়।

বিজ্ঞাপন

শাটল [কর্ক] : শাটলটির ওজন ৪.৭৪ গ্রামের কম অথবা ৫.৫০ গ্রামের বেশি হবে না। এর মধ্যে ১৪ থেকে ১৬টি পালক থাকবে।

খেলোয়াড় : একক ম্যাচে উভয়পক্ষে ১ জন করে সর্বমোট ২ জন খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করে। দ্বৈত খেলায় উভয়পক্ষে ২ জন করে। সর্বমোট ৪ জন অংশগ্রহণ করে।

খেলার নিয়ম ও পয়েন্ট :একক ও দ্বৈত উভয় খেলায় সাধারণত ১৫ থেকে ২১ পয়েন্টে গেম হয়। উভয় খেলোয়াড় বা দল ২০-২০ পয়েন্ট অর্জন করলে সেক্ষেত্রে ২ পয়েন্টের ব্যবধানে এগিয়ে থেকে জয়লাভ করতে হবে, অর্থাৎ ২২-২০, ২৫-২৩ ইত্যাদি।উভয় দলের পয়েন্ট সমান হওয়াকে ডিউস বলে। মনে রাখতে হবে, এভাবে সর্বোচ্চ ৩০ পয়েন্টের মধ্যে অবশ্যই গেম শেষ করতে হবে। তিনটি গেমের মধ্যে যে বা যে দল দুই খেলায় জিতবে, তারাই বিজয়ী হবে।একক খেলার সময় সার্ভিসকারীর পয়েন্ট শূন্য বা জোড় সংখ্যা হলে খেলোয়াড় তাদের ডান দিকের কোর্ট থেকে সার্ভিস করবে এবং বিজোড় সংখ্যা হলে বাম দিকের কোর্ট থেকে সার্ভিস করবে। প্রতি পয়েন্টের পর খেলোয়াড়রা তাদের সার্ভিস বা রিসিভ কোট বদল করবে ।দ্বৈত খেলার সময় প্রথম সার্ভিসের জন্য ডানদিকের খেলোয়াড় কোনাকুনি বিপক্ষের কোর্টে সার্ভিস করবে। যাকে সার্ভিস করা হবে কেবল সেই খেলোয়াড় সার্ভিস গ্রহণ করবে। কোনো খেলোয়াড় পরপর দুইবার সার্ভিস করতে পারবে না। প্রথম গেমে বিজয়ী খেলোয়াড় দ্বিতীয় গেমে সার্ভিস শুরু করবে। সার্ভিসের সময় সার্ভারের দুই পা মাটি স্পর্শ করে থাকবে। সার্ভিস করার সময় শাটল নেটে লেগেও যদি ঠিকোর্টে পড়ে তবে সার্ভিস ঠিক হয়েছে বলে ধরা হবে। শাটল দাগ স্পর্শ করলেই সার্ভ করা ঠিক হয়েছে বলে ধরা হবে। নেট অতিক্রম করে কেউ শাটলে আঘাত করতে পারবে না এবং খেলা চলাকালে কেউ র‌্যাকেট বা শরীরের কোনো অংশ দিয়ে নেট ও পোস্ট স্পর্শ করতে পারবে না।

সরঞ্জাম ও কেনাকাটা : খেলার কোর্ট কাটতে বাঁশসহ খরচ পড়বে ৫শ থেকে এক হাজার টাকা। লাইটের জন্য খরচ হবে এক থেকে দেড় হাজার টাকার মতো। কোটে টানানোর জন্য পাঁচশ’ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে নেট পাওয়া যাবে বাজারে। আর যাজকেটের দাম শুরু হবে তিনশ’ টাকা থেকে। তবে তিন হাজার টাকার মধ্যে অনেক ভালো র‌্যাকেট পাওয়া যায়। আর প্রতিদিন খেলার জন্য একটা ফেদার বা কর্ক তো লাগবেই। প্রতিটি ফেদারের দাম পড়বে ত্রিশ থেকে একশ’ বিশ টাকা। এগুলো খুব সহজেই পেয়ে যাবেন এলাকার বিভিন্ন স্পোর্টসের দোকানগুলোতে।

জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে ব্যাডমিন্টন খেলাকে বাংলাদেশের জনপ্রিয় খেলা বলা যায় কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। কেননা, শীত মৌসুম এলেই ব্যাডমিন্টন খেলার তোড়জোড় লক্ষ্য করা যায়। এ সময়কে বিবেচনায় নিয়ে এলে মনে হবে ব্যাডমিন্টনই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো সম্পূর্ণ বিপরীত। শীত মৌসুম বাংলার প্রকৃতি থেকে বিদায় নেওয়ার সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলাও বাংলার আকাশ থেকে প্রায় হারিয়ে যায় বললেই চলে।ব্যাডমিন্টনপ্রেমীরা ব্যক্তিগত ও অফিসিয়াল কাজের ব্যস্ততা থেকে নিজের জন্য একটু সময় বের করে বাঁচিয়ে রাখেন এই খেলা।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ:

সর্বাধিক পঠিত