মোট কত টাকার মালিক হলেই আপনার উপর কুরবানি ওয়াজিব?

চট্টগ্রাম ট্রিবিউন ডেস্ক,
স্বর্ণ-রূপা হিসেবে নেসাব তো সকলের জানা থাকার কথা। টাকা হিসেবে নেসাব নির্ণয় করতে হলে রূপার বাজার দাম বের করতে হবে। ৫২.৫ ভরি রূপার মূল্যই হল নেসাব। ৫২.৫ ভরি রূপা সমতূল্য টাকা থাকলেই কুরবানি ওয়াজিব হবে।

সাধারণত বাজারে তিন ক্যাটাগরির রূপা বিদ্যমান। প্রত্যেক ক্যাটাগরিতেই কমবেশ খাদ (ভেজাল) মিশ্রিত। (১) ২২k—এতে ৯১.৬৬% রূপা; বাকি ৮.৪৪% খাদ।
(২) ২১k—এতে ৮৭.৫০% রূপা; বাকি ১২.৫০% খাদ। (৩) ১৮k—এতে ৭৫% রূপা; বাকি ২৫% খাদ। এ তিন প্রকারের বাইরে আরেক ক্যাটাগরির রূপা আছে। তা হল (৪) সনাতন রূপা—এই রূপার খাঁটি ও খাদ সম্পর্কে নিশ্চিত জানা যায় না। সাধারণত ২৫% থেকে শুরু করে ৬০% এমনকি ৭৫% পর্যন্ত খাদ থাকে।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) এর দেয়া তথ্য মতে আজকের (৩/৭/২২ঈসায়ী) রূপার মূল্য (স্বর্ণ-রূপার মূল্য পরিবর্তনশীল। তবে কুরবানি আসতে মাত্র সাত দিন বাকি। এত অল্প সময়ে দাম পরিবর্তন না হওয়ার সম্ভাবনায় বেশি।) হল এই:—২২k প্রতি ভরি ১৫১৬ টাকা। ২১k প্রতি ভরি ১৪৩৫ টাকা। ১৮k প্রতি ভরি ১২২৫ টাকা। সনাতন প্রতি ভরি ৯৩৩ টাকা।

সুতরাং ৫২.৫ ভরি রূপার দাম হল:—
(১) ২২k ১৫১৬ × ৫২.৫= ৭৯,৫৯০ টাকা
(২) ২১k ১৪৩৫ × ৫২.৫= ৭৫,৩৩৮ টাকা
(৩) ১৮k ১২২৫ × ৫২.৫= ৬৪,৩১৩ টাকা
(৪) সনাতন ৯৩৩ × ৫২.৫= ৪৮,৯৮৩ টাকা

চার প্রকারের কোন ক্যাটাগরির দাম হিসেব করে নেসাব ঠিক করা হবে? এর উত্তর দেয়ার আগে দুটি জরুরি মাসআলা জানা যাক—

(১) স্বর্ণ-রূপায় সচারাচর খাদ থাকে। খাদ ছাড়া ১০০% স্বর্ণ বা রূপা ব্যবহারযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে ফিকাহর মাসআলা হল: আসল ও খাদের মধ্যে আধিক্যের দিকে লক্ষ্য করে হুকুম আরোপিত হবে। অর্থাৎ খাঁটি রূপার পরিমাণ বেশি, খাদের পরিমাণ কম—তাহলে তা খাঁটি রূপা হিসেবে গণ্য করা হবে। পক্ষান্তরে খাদ বেশি হলে সেটাকে রূপা বলা হবে না; বরং তাকে খাদ (GST) বলা হবে। (বাদায়েউস সানায়ে: ২/১৮, রদ্দুল মুখতার: ২/৩০০; আল-ইখতিয়ার লিতালিলিম মুখতার: ৯)

(২) কয়েক ধরণের রূপা (দেরহাম) এর প্রচলন থাকলে যে রূপা অত্যাধিক প্রচলিত—তা গ্রহণযোগ্য হবে। (রদ্দুল মুখতার: ৪/৫৩৬)

তাহলে আমরা বলতে পারি: সনাতন রূপার দাম হিসেব করে নেসাব ঠিক করা ফিকহ-সম্মত নয়। কারণ—

(১) আমরা বাজুস এবং সরেজমিনে স্বর্ণ-মার্কেটে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি যে, সনাতন রূপায় খাদের পরিমাণ নিশ্চিত নয়। ২৫% থেকে শুরু করে ৭৫% পর্যন্ত হতে পারে। প্রশ্ন হল—এরকম অনিশ্চিত কেন? কারণ হল, সনাতন রূপা মানে পুরাতন রূপা। রূপার ক্যাটাগরি (২২k ২২k ১৮k) নির্ণীত হয়েছে মাত্র দুবছর আগে। এই ক্যারেটের হলমার্ক (সত্যায়ন) ছাড়া দুবছর পূর্বের রূপাকেই সনাতন রূপা বলা হয়। আর তাতে কতো পার্সেন্ট খাদ বা ভেজাল ছিল—তার কোন সঠিক হিসেব নেই। সুতরাং বলা যায়, সনাতন রূপায় ৫০% এর বেশি খাদ থাকার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। অতএব তা রূপার গণ্ডি থেকে বের হয়ে খাদ হিসেবে পরিগণিত হবে।

(২) তাছাড়া মার্কেটে সনাতন রূপা বলতে কোন রূপার অস্তিত্ব নেই। কারণ, দুবছর আগের বানানো রূপাগুলো মানুষের হাতে হাতেই কিছুটা বিদ্যমান আছে মাত্র। উপরন্তু বাজুস বলছে—ক্যাটাগরি নির্ণয় করা ছাড়া সনাতন রূপার বেচাকেনা নিষিদ্ধ। সুতরাং দ্বিতীয় মাসআলার আলোকেও সনাতন রূপার রেওয়াজ না থাকার কারণে তার দাম ধরে নেসাব ঠিক করা যাবে না।

সনাতন ছাড়া বাকি আছে তিন ক্যাটাগরির রূপা। তিনো প্রকারের রূপায় কিছুটা খাদ থাকলেও তা অতি সামান্য। সর্বোচ্চ ২৫ পার্সেন্ট। সুতরাং তাতে রূপার হুকুমই আবর্তিত হবে। তাছাড়া তিনো প্রকারের রূপার প্রচলন ও রেওয়াজ আছে। এখন কথা হল এই তিন ক্যাটাগরির রূপার কোনটি হিসেব করে নেসাব বের করা হবে? এর উত্তর দেয়ার আগে কয়েকটি কথা জেনে নেই:—

(১) ইসলামের প্রথম যুগে ৫২.৫ ভরি রূপা ও ৭.৫ ভরি স্বর্ণ দামে ও মানে সমান ছিল। কালের আবর্তে রূপার দাম কমতে থাকে। এখনো রূপার দাম নিম্নমুখী। সুতরাং নিম্নমানের রূপার দাম হিসেব করা যাবে না। (তাবয়িনুল হাকায়েক: ১/২৭৬, দুররে মুখতার: ২/২৯৯)

(২) উত্তম, মধ্যম ও নিম্ন—তিন ধরণের দেরহাম (রূপা) এর প্রচলন থাকলে মধ্যম (মিডিয়াম) ক্যাটাগরির হিসেব করা হবে। এটিই যুক্তিযুক্ত। কারণ, ফিকাহর অনেক মাসআলায় ক্যাটাগরিতে ভিন্নতা দেখা গেলে ‘মধ্যম’ ধর্তব্য হয়। (সূরা মায়দা: আয়াত, ৮৯; মাবসুতে সারাখসি: ২/১৫২; বাহরুর রায়েক: ১/২৪)

তাহলে তিন ক্যাটাগরি থেকে মধ্যম মানের (২১k) রূপার মূল্য যদি আমরা নির্ধারণ করি, তাহলে দাম হবে ৭৫,৩৩৮ টাকা। ভাংতি ৩৩৮ টাকা বাদ দিয়ে বলতে পারি—এ বছরের সর্বনিম্ন নেসাব ৭৫,০০০ টাকা। মৌলিক প্রয়োজন ও কর্জ বাদ দিয়ে যদি কেউ ৭৫,০০০ টাকা বা সমপরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তাহলে তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে। এর কম টাকার মালিক হলে কুরবানি ওয়াজিব হবে না।

বি. দ্র. তাহিককটি করেছি আমার দুজন উস্তাদ, বাংলাদের মুহাক্কিক ও যুগসচেতন মুফতির পরামর্শে ও তত্ত্বাবধানে:—
১. আল্লামা মুফতি শামসুদ্দিন জিয়া সাহেব হাফি. -মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া।
২. মাওলানা মুফতি মনযুর সিদ্দিক সাহেব হাফি.
-মুদির ও মুফতি, জামিয়াতুস সাকাফা ঢাকা।
সমাধান বের করতে গিয়ে মুতালাআ ও তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি উস্তাদদ্বয় এবং আরো অনেক মুফতির সাথে বারংবার মুজাকারা ও মতবিনিময় করেছি। এতত্সত্ত্বেও নতুন মাসআলা (নাওয়াজেল) হিসেবে মতভিন্নতার সুযোগ আছে। সুতরাং তথ্য ও দলিলের আলোকে ভিন্ন মত পোষণ করা যাবে।

————————————
ফিকহি দলিল-প্রমাণ সমূহ:

[١] الدر المختار وحاشية ابن عابدين-رد المحتار-٢/٣٠٠:
(قَوْلُهُ: وَغَالِبُ الْفِضَّةِ إلَخْ) ؛ لِأَنَّ الدَّرَاهِمَ لَا تَخْلُو عَنْ قَلِيل غِشٍّ؛ لِأَنَّهَا لَا تَنْطَبِعُ إلَّا بِهِ فَجُعِلَتْ الْغَلَبَةُ فَاصِلَةً نَهْرٌ، وَمِثْلُهَا الذَّهَبُ.

[٢] الاختيار لتعليل المختار-ص: 9، بترقيم الشاملة آليا:
وتعتبر فيهما الغلبة، فإن كانت للغش فهي عروض، وإن كانت للفضة فهي فضة، وكذلك الذهب.

[٣] الدر المختار وحاشية ابن عابدين-رد المحتار-٤/٥٣٦:
أَمَّا إذَا اخْتَلَفَتْ رَوَاجًا مَعَ اخْتِلَافِ مَالِيَّتِهَا أَوْ بِدُونِهِ فَيَصِحُّ، وَيَنْصَرِفُ إلَى الْأَرْوَجِ.

[٤] بدائع الصنائع في ترتيب الشرائع-٢/١٨:
وكذا حكم الدنانير التي الغالب عليها الذهب كالمحمودية والصورية ونحوهما.

[٥] بدائع الصنائع في ترتيب الشرائع-٢/١٦:
قال أصحابنا: لا تجب الزكاة فيه؛ لأنه وقع الشك في كمال النصاب فلا نحكم بكماله مع الشك والله أعلم.

[٦] تبيين الحقائق شرح كنز الدقائق وحاشية الشلبي-١/٢٧٦:
وَكَانَ الدِّينَارُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ-صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – مُقَوَّمًا بِعَشْرَةِ دَرَاهِمَ.

[٧] الدر المختار وحاشية ابن عابدين-رد المحتار-٢/٢٩٩:
وَفِي الْهِدَايَةِ كُلُّ دِينَارٍ عَشَرَةُ دَرَاهِمَ فِي الشَّرْعِ.

[٨] المائدة-الآية-٨٩:
فَكَفَّارَتُهُ إِطْعَامُ عَشَرَةِ مَسَاكِينَ مِنْ أَوْسَطِ مَا تُطْعِمُونَ أَهْلِيكُمْ أَوْ كِسْوَتُهُمْ أَوْ تَحْرِيرُ رَقَبَةٍ ۖ فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ.

[٩] البحر الرائق شرح كنز الدقائق ومنحة الخالق وتكملة الطوري-١/١٢٤:
وَرُوِيَ عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ فِي الْفَأْرَةِ أَرْبَعُونَ فَإِذَا بَعْضُهُمْ أَوْجَبَ فِي الْفَأْرَةِ عِشْرِينَ وَبَعْضُهُمْ أَقَلَّ مِنْ عِشْرِينَ، وَبَعْضُهُمْ أَكْثَرَ مِنْ عِشْرِينَ فَأَخَذَ عُلَمَاؤُنَا بِالْعِشْرِينَ؛ لِأَنَّهُ الْأَوْسَطُ بَيْنَ الْقَلِيلِ وَالْكَثِيرِ فَكَانَ هُوَ وَاجِبًا لِتَعَيُّنِهِ.

[١٠] المبسوط للسرخسي-٢/١٥٢:
ثُمَّ أَعْدَلُ الْأَسْنَانِ بِنْتُ اللَّبُونِ وَالْحِقَاقُ، فَإِنَّ أَدْنَاهَا بِنْتُ الْمَخَاضِ وَأَعْلَاهَا الْجَذَعَةُ وَالْأَعْدَلُ هُوَ الْأَوْسَطُ، وَكَذَلِكَ أَعْدَلُ الْأَوْقَاصِ هُوَ الْعَشْرُ، فَإِنَّ الْأَوْقَاصَ فِي الِابْتِدَاءِ خَمْسٌ، وَفِي الِانْتِهَاءِ خَمْسَةَ عَشْرَ فَالْمُتَوَسِّطُ هُوَ الْعَشْرُ وَهُوَ الْأَعْدَلُ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here