আরিফুল ইসলাম,
চট্টগ্রাম ট্রিবিউন প্রতিবেদক:
“জীবে প্রেম করে যে জন,সেই জন সেবিছে ইশ্বর!”
সুমি বিশ্বাস। একজন পশু প্রেমিক, পশুর প্রতি তার অপার মায়া।অসহায় অবলা বোবা প্রাণীদের নিয়ে কাজ করার জন্য আগে থেকে কোনও পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না তার,কিন্তু নিজের পোষা প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই রাস্তায় থাকা অবাঞ্ছিত প্রাণীদের প্রতি মমতা তৈরি হয়। এছাড়া মানুষের অহেতুক এদের উপর নির্যাতন। প্রায় দেখি রাস্তার কুকুরের পা ভাঙা, চামড়া ঝলসানো, মাথা ফাটা,কেটে দেওয়া, এমনকি চোখ উপড়ানো। আর ছানা অবস্থায় নয় ড্রেনে ফেলে দেয়,নয় পুড়িয়ে মারে, নয়তো ডাস্টবিনে ফেলে দেয়।এইসব দেখার পর সহ্য করতে না পেরে ওদের জন্য কাজ করা শুরু হয়।
অবলা এইসব প্রানীর প্রতি মমত্ববোধ থেকেই প্রতিষ্ঠা করেন ‘এনিমেল কেয়ার অব চট্টগ্রাম ‘ নামে একটি সংগঠন। ২০১৫ সালে ধীর পায়ে এর যাত্রা শুরু হলেও ২০১৬ সাল থেকে পুরো দমে কাজ করে যাচ্ছে এই সংগঠনটি।বর্তমানে সংগঠনটির সদস্য সংখ্যা আছে ৩০জন।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সুমি বিশ্বাসের কাছে তার সংগঠনের উদ্দেশ্য ও কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি চট্টগ্রাম ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের কাজের উদ্দেশ্য হলো রাস্তার অবলা কুকুর -বিড়ালদের জন্য একটা সুস্থ জীবন নিশ্চিত করা। এদের সময় মত প্রতিবছর টিকা দিয়ে জলাতঙ্ক রোধ করা, এদের বংশবিস্তার কমানোর জন্য নিউটার স্প্রের ব্যবস্থা করা, অসুস্থ এবং আহত প্রানীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া এবং তাদের সাথে ঘটা নির্যাতন রোধ করার জন্য এলাকাভিত্তিক জনসচেতনা মুলক কার্জকর্ম পরিচালনা করা।
চিকিৎসা প্রদান করার জন্য আমাদের একটা ছোট শেল্টার আছে। যেখানে আহত এবং অসুস্থ প্রাণীদের রাখা হয়।’
এক পর্যায়ে তিনি বলেন,আমাদের অনেক সদস্য মাঠ পর্যায়ে কাজ করে। যেমন -রেসকিউ, স্পট ট্রিটমেন্ট সহ বিভিন্ন ধরনের ক্যাম্পেইন কর্মসূচি করে থাকে।
বর্তমানে করোনাকালেও থেমে নেই সংগঠনটির কার্যক্রম। প্রতিনিয়ত ছুটে চলছে সংগঠনটির একদল স্বপ্নবাজ তরুণ ।সম্পূর্ণ অলাভজনক এই সংগঠনটিতে যারা স্বেচ্ছায় অর্থ প্রদান করে তাদের অর্থে চলে সংগঠনটির কার্যক্রম।কিন্তু এই অর্থের পরিমাণ খুবই কম। প্রানীদের টিকা, নিউটার স্প্রে, চিকিৎসা প্রদানের জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন হয় যেটি এই সামান্য অর্থ দিয়ে হয় না। ফলে দেখা যায় অনেক আহত অসুস্থ প্রানীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে তাদের হিমশিম খেতে হয়।এ বিষয়ে সুমি বিশ্বাস বলেন,’সাধারণত মানুষ আমাদের কাজের প্রশংসা করলেও অর্থ সহযোগিতা দিয়ে কেউ পাশে থাকতে চায় না।’ আমরা বুঝাতে পারি না যে যেকোনো প্রাণীর চিকিৎসা কার্জক্রম চালানোর জন্য চিকিৎসা ফি, ঔষধের খরচ থাকে, যেগুলো অর্থ ছাড়া সম্ভব না। বর্তমানে আমাদের যে ছোট শেল্টার রয়েছে সেটিকে বড় করার ইচ্ছে আছে । কিন্তু সেটাও অর্থের অভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক আহত অসুস্থ প্রানীদের আমরা ইচ্ছে থাকলেও রাখতে পারি না অর্থের অভাবে। একটি প্রানীকে রাখা মানে হচ্ছে তার খাবার, ঔষধ, ও পরিচর্যা নিশ্চিত করা। বিনা অর্থে সেগুলো ঠিক মত করা সম্ভব না।
আমাদের সংগঠনটির যাত্রা শুরু থেকে এইসব কাজ করতে গেলে যেমন অনেকের বাহবা পেয়েছি তেমনি সমস্যাও অনেক এসেছে। আমরা যখন কোনো প্রাণী নিয়ে কাজ করতে যাই অনেকে বিরূপ মন্তব্য করে। বলে, কেন আমরা মানুষের জন্য করি না কুকুরের জন্য করি! অনেকে আজেবাজে গালিও দেয়, এমনকি হুমকিও দেয়। আমাদের মনোবল ভাঙতে চেষ্টা করে। এসব যথা সম্ভব এড়িয়ে যাই। কারণ আমরা কাজ করি ঐসব বোবা প্রানীদের জন্য যারা নিজেদের কষ্টের কথা বলতে পারে না। আমরা মানুষ হয়ে যদি তাদের না বলা কথা, যন্ত্রণা , না বুঝি তাহলে নিজেদের মানুষ হিসেবে দাবি করি কীভাবে!
যারা প্রানীদেরপ্রতি সদয় আচরণ করেন, সমাজে যারা উচ্চ পর্যায়ে বসবাস করেন তাদের প্রতি আমাদের একটাই আবেদন আপনারা আমাদের সংগঠনের জন্য এগিয়ে আসুন। হয়তো আপনারা নিজে প্রাণীদের জন্য কিছু করতে পারছেন না, কিন্তু ইচ্ছে আছে আমাদের সংগঠনের জন্য অর্থ দিয়ে অবলা এই প্রাণীগুলোর জীবনে একটু স্বাচ্ছন্দ্য আনুন। আপনাদের যাদের প্রচুর অর্থ রয়েছে তারা সামান্য এই অভুক্ত অবহেলিত, অত্যাচারিত প্রানীদের জন্য দান করুন।
সংগঠনটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাইলে সুমি বিশ্বাস বলেন,’আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে আমরা একটি বড় শেল্টার করবো এবং একটি হাসপাতাল করবো যেখানে যেসব প্রানী রাস্তায় স্বাভাবিক ভাবে থাকতে পারেনা আলাদা যত্নের দরকার তাদের আশ্রয় হবে। চিকিৎসা দেওয়া হবে বিনামূল্যে,কিন্তু এত বড় পরিকল্পনা আমাদের নিজেদের পক্ষে করা সম্ভব না,তাই সরকারি ভাবে সাহায্য, সমাজের বিত্তশালীদের সাহায্য আমাদের অতি প্রয়োজন।
পাশাপাশি কুকুরদের জলাতঙ্ক রোগের টিকাও দেওয়া হয় এলাকাভিত্তিক। সাধারণত আমরা এলাকা ভাগ করে টিকা দিয়ে থাকি,টিকা দেওয়ার সময় আশেপাশে মানুষদের এদের প্রতি মানবিক হতে অনুরোধ করি। তাদের যেন নির্যাতন না করে সেই বিষয়েও বুঝানো হয়। ‘বর্তমানে আমাদের দেশে প্রাণী নির্যাতন রোধের জন্য আইন করা হয়েছে। আমরা মানুষদের সে আইন সম্পর্কে বুঝানোর চেষ্টা করি।’
আমাদের সংগঠন নিজেদের অর্থায়নে চলছে। আমাদের নিজেদের শখ, আহ্লাদ বাদ দিয়ে শুধু মাত্র এই অবলা প্রানী গুলো জন্য চিন্তা করি। আমাদের সদস্যরা মাসিক অর্থ দিয়েও সাহায্য করে। অনেক সময় যে মাসে আমাদের অর্থের অভাব হয় তখন আমরা ফান্ড পোস্ট দিই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রানী প্রেমিরা সেই পোস্ট দেখে আমাদের সাহায্য করে।
বর্তমানে সংগঠনটির একটি ফেসবুক পেইজ ও গ্রুপ রয়েছে, যেখানে প্রতিনিয়ত সংগঠনটির সকল কার্যক্রম তুলে ধরা হয়
এসময় সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সুমি বিশ্বাস এর কাছে সিটি করপোরেশন এর নিকট সংগঠনটির জন্য কোনো সহযোগিতার প্রত্যাশা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন,চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন থেকে যদি বন্ধ্যাত্বকরন (নিউটার/স্প্রে) এবং ভ্যাকসিন সহায়তা করেন তাহলে ভালো হয়।
এসময় তিনি আরো বলেন,বর্তমানে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে চলমান লক ডাউনে “পথ প্রানীদের খাবার আয়োজন ” নামে ৪ মাস ব্যাপী একটি ইভেন্ট কার্যক্রম করা হয়। এতে আমরা প্রচুর সাড়া সহ অর্থনৈতিক সহযোগিতা পাই
তবে আমাদের সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এর মাননীয় মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিন।
কিছু মানুষের প্রানীদের প্রতি অহেতুক ক্ষোভ কাজ করে কিন্তু আমরা ভুলে যাই আমাদের মত এরাও একটা প্রাণ।এদের ও যন্ত্রণা হয় । এরা সারাদিন এক ডাস্টবিন থেকে অন্য ডাস্টবিনে ছুটে বেড়ায় শুধুমাত্র সামান্য একটু খাবারের আশায়। ক্ষুধার যন্ত্রণা যেমন মানুষের হয় তেমনি এই অবলা প্রানীদের ও হয়ে থাকে।
পরিশেষে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সুমি বিশ্বাস বলেন, সমাজের মানুষের কাছে আমাদের একটাই প্রত্যাশা আমাদের কাজে এগিয়ে আসুন। আমাদের শেল্টারকে আমরা এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত করতে পারিনি। সবার সহযোগিতা ছাড়া আমাদের পুরো-দমে কাজ করাও সম্ভব হচ্ছে না।তাই সকলের সহযোগিতা কামনা করছি।
আমাদের উচিৎ সবার নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসা। নিজেদের খাবার থেকে ক্ষুধার্ত এই অবলা প্রানীদের একমুঠ খাবার দিলেও প্রচুর তৃপ্তি নিয়ে খাবে এরা। এই পৃথিবীতে বাঁচতে হলে সবাইকে নিয়েই আমাদের বাঁচা উচিৎ।