মোহাম্মদ মনির, কর্ণফুলী:
পশ্চিম পটিয়া তথা কর্ণফুলী উপজেলায় অন্য জেলা-উপজেলার মত ব্যবহার হত হারিকেন। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী একটি নিদর্শন মনে করত হারিকেনকে। কত গল্প, উপন্যাসে হারিকেনের উপমা ব্যবহার হয়েছে তার শেষ নেই। অনেক বাড়িতে সন্ধ্যায় হারিকেন জ্বালানোর আগে পৌঁছাতে না পারলে পিটুনি খেতে হয়েছে, এমনও শোনা গেছে। হারিকেন জ্বলা মানে পড়াশোনার সময় হয়ে গেছে। সে সময় পড়াশোনাসহ সব ধরনের প্রয়োজনেই ঘরে ঘরে হারিকেন জ্বলত। বর্তমানে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যাপক প্রসারে কমে গেছে হরিকেনের চল। এরই ধারাবাহিকতায় সারাদেশের মতো কর্ণফুলীতেও কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে হারিকেন। বিদ্যুতের প্রসার, বিদ্যুৎ চলে গেলে বিভিন্ন ধরনের চার্জার বাতির ব্যবহারে হারিকেনের তেমন একটা প্রয়োজন হয় না। তাই হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী হারিকেন।তবে এখনও উপজেলার কিছু কিছু দুর্গম এলাকায় হারিকেনের প্রচলন রয়েছে। তবে চার্জার বাতির অধিক ব্যবহারের কারণে সেটাও সংখ্যায় খুব কম। এক সময় এটা হারিয়ে জাদুঘরে চলে যাবে। তখন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো হারিকেন দেখতে জাদুঘরে যাবে। বইয়ের পাতায় খুঁজবে হারিকেনের ইতিহাস।
আদিযুগের সময়ে গ্রাম বাংলায় হারিকেন ছিল অতি প্রাচীন পরিচিত একটি জিনিস, যাকে তখনকার সময়ে রাত্রিকালীন বন্ধু হিসাবে আখ্যায়িত করত অনেকেই। হারিকেনের আলো গৃহস্থালির পাশাপাশি ব্যবহার হতো রেলগাড়ি ও বিভিন্ন যানবাহনে। রাতের আঁধারে হারিকেন জ্বালিয়ে পোস্ট অফিসের ডাক নিয়ে ছুটতেন ডাক হরকরা। এমনকি রাতের বেলায় মাছ ধরতে গেলেও হারিকেন ব্যবহার করত। কিন্তু সভ্যতার আধুনিকায়নে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্সলাইটে বাজার ভরপুর ও জ্বালানি কেরোসিন তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়ের আলোর একমাত্র উৎস হারিকেন।
বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা গেছে, হারিকেন হচ্ছে জ্বালানি তেলের মাধ্যমে বদ্ধ কাঁচের পাত্রে আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা। এর বাহিরের অংশে অর্ধবৃত্তাকার কাঁচের অংশ থাকে যাকে গ্রামীণ জনপদে চিমনি বলে আর এর ভিতরে থাকে তেল শুষে অগ্নি সংযোগের মাধ্যমে আলো জ্বালাবার জন্য কাপড়ের শলাকা। আর সম্পূর্ণ হারিকেন বহন করবার জন্য এর বহিরাংশে থাকে একটি লোহার ধরনি। আলো কমানো বা বাড়ানোর জন্য নিম্ন বহিরাংশে থাকে একটি চাকতি যা কমালে বাড়ালে শলাকা ওঠা নামার সাথে আলো কমে ও বাড়ে।
জানা যায়, তখনকার সময়ে হারিকেন মেরামতের জন্য পশ্চিম পটিয়া তথা কর্ণফুলী উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজার, ফাজিল খঁর হাট, জামতল বাজার, মিয়ার হাট, বাংলা বাজার, ক্রসিং, মইজ্জ্যারটেক, মাস্টার হাটসহ বিভিন্ন হাট-বাজারে মিস্ত্রী বসতো। এদের স্থানীয় ভাষায় ডাকা হতো মেরামতি বলে। এছাড়া উপজেলার প্রতিটি বাজারে ছিল হারিকেন মেরামতির অস্থায়ী দোকান। এরা বিভিন্ন হাট বাজারে ঘুরে ঘুরে হারিকেন মেরামতের কাজ করতো। এছাড়া অনেকে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে হারিকেন মেরামত করতো।
হারিকেন মেরামত করা লোকজনরা জানান, অনেকদিন ধরে মেরামতির কাজ করছি। তবে তখনকার সময় গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে ছিল হারিকেনের ব্যবহার। এতে কাজও হতো প্রচুর। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক ইলেকট্রনিক্সলাইটে বাজার ভরপুর হওয়ায় হারিকেনের প্রচলন বন্ধ হয়ে গেছে।
কর্ণফুলী উপজেলার বাসিন্দা আরিফুর রহমান জানান, ছোটকালে রাতে পড়তে বসার আগে হারিকেন নিয়ে ভাই-বোনদের মধ্যে টানা-টানি চলতো। হারিকেন নিয়ে কত গল্প শুনেছি। কিন্তু এখন ঘরে ঘরে পৌছে গেছে বিদ্যুৎ। তাছাড়া বাজারে বিভিন্ন ধরনের চার্জার এলইডি বাল্ব অনেক কম দামে পাওয়া যায়। যার কারনে এখন আর হারিকেনের প্রয়োজন হয় না।
গ্রামীণ জীবনে অন্ধকার দূর করতে একমাত্র অবলম্বন ছিল হারিকেন কিন্তু কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে হারিকেন। আগেকার দিনে হারিকেন জ্বালিয়েই বাড়ি উঠানে বা বারান্দায় পড়াশোনা করত শিক্ষার্থীরা। রাতে পথ চলার জন্য ব্যবহৃত হতো হারিকেন। হারিকেনের জ্বালানি তেল বাজার থেকে আনতে প্রতি বাড়িতেই থাকত কাচের বিশেষ ধরনের বোতল। সেই বোতলে রশি লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হতো। সেই রশিতে ঝুলানো বোতল হাতে হাটবাজারে যেতেন মানুষ। পল্লী বিদ্যুতায়নের যুগে প্রাচীন বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্য হারিকেন এখন শুধুই স্মৃতি। যেখানে গ্রাম বাংলার প্রতি গৃহের অতি প্রয়েজনীয় হারিকেন আজ বিলুপ্ত । গ্রামের অমাবশ্যার রাতে মিটি মিটি আলো জ্বালিয়ে মানুষের পথ চলার স্মৃতি এখনও তাড়া করে।
কর্ণফুলীর বাসিন্দা আরাফাত বলেন, এক সময় হারিকেন নিয়ে ডাকপিয়নরা ছুটে চলতেন গ্রামের পর গ্রামে। বৃদ্ধ থেকে শুরু করে সবাই রাতের বেলায় হারিকেন নিয়ে বের হতেন। হারিকেনের আলো গৃহস্থালির পাশাপাশি ব্যবহার হতো বিভিন্ন গ্রাম্য যানবাহনেও। কিন্তু আধুনিকায়নে বিভিন্ন বৈদ্যুতিক বাতিতে বাজার ভরপুর। যার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়ের আলোর অন্যতম উৎস ঐতিহ্যবাহী হারিকেন। কিন্তু এ যোগে যেভাবে হারিকেন হারিয়ে যাচ্ছে মনে হয় আগামী প্রজন্ম জানবেওনা হারিকেন কি? যদিও নামটা শুনে তাহলে হারিকেন খুজতে জাদুঘরে বা বইয়ের মধ্যে ছাড়া আর কোথাও পাবেনা।
হারিকেন মেরামতকারী আরমান গাজী বলেন, এক সময় বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নিজের হাতে অনেক হারিকেন মেরামত করেছি। কিন্তু এখন কারও ঘরে হেরিকেন থাকলেও তা কেউ ব্যবহার করে না। এর ফলে মেরামতের কাজও তেমন হয় না। যার কারণে এই পেশা ছাড়তে হয়েছে।