ইমতিয়াজ চৌধুরী, স্পোর্টস ডেস্কঃ
এই তো ক’দিন আগেও কি ভেবেছিলো কেউ আমাদের নামের পাশেও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন লেখা থাকবে? আমাদেরও একটি বিশ্বকাপ হয়ে যাবে? না, মোটেই না। সেই অভাবনীয় কাজটিই করেছে লাল-সবুজকে সবে বিশ্ব দরবারে তোলে ধরতে শেখা এক ঝাঁক যুবক। বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল।
হ্যাঁ ‘আকবর আলী’, ভূল বললাম। ‘আকবর দ্যা গ্রেট’ এর দলের কথা বলছি। শরীফুল, হৃদয়, ইমনদের নিয়ে সুদূর পচেমস্ট্রমে পাড়ি জমান দলনেতা আকবর। চোখে স্বপ্ন, বুকে আত্মবিশ্বাস। গড়তে যে হবে নতুন ইতিহাস। লাল-সবুজের পতাকা আরো একবার উড়াতে যে হবে আকাশ-বাতাস।
দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে ২০২০ অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ। মেগা ইভেন্টে সাফল্য পেতে মাঠের লড়াইয়ে নামার সপ্তাহ আগেই পচেমস্ট্রমে তাবু গাড়েন টাইগাররা। অনুশীলন, সাথে কন্ডিশনের পাঠ নেওয়া। উদ্দেশ্য একটাই, বিশ্বকাপ শিরোপা জয়। ১৮ই জানুয়ারি থেকে ৯ই ফ্রেব্রুয়ারী, ২৩ দিনের এই বিশ্বকাপ যুদ্ধে শেষ হাসিটা টাইগারদের, বাংলাদেশের।
১৮ই জানুয়ারি ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিতে জিম্বাবুয়েকে ৯ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি টাইগার যুবাদের। সামনের সব বাঁধা পেরিয়ে পৌঁছে যান ফাইনালে। ফাইনালের পথে তারা হারিয়েছে স্কটল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নিউজিল্যান্ডকে।
কোয়ার্টার ফাইনালে ১০৪ রানে হারিয়ে টুর্নামেন্ট থেকে স্বাগতিকদের বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে দেয় বাংলাদেশ। সেমিফাইনালে রুখে দেয় আরেক শক্তিশালী দল নিউজিল্যান্ডকে। সেদিন কিউই দের বিপক্ষে রৌদ্রমূর্তি ধারণ করেন মাহমুদুল হাসান জয়। ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির সাথে বাংলাদেশকেও পৌঁছে দেন প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে।
বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের এই বড় আসরে বাংলাদেশের এর আগের সর্বোচ্চ সফলতা সেমিফাইনাল খেলা। ২০১৬ তে ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে মিরাজ-শান্ত-জাকিররা পেয়েছিলেন সেই সাফল্য। এর আগে ২০১২ তে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে বিজয়-সৌম্যদের দৌড় ছিল কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত। পারেননি সাকিব-মুশফিকরাও।
সেই অধরা স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে যখন আকবর-ইমনদের সামনে ভারত ঝুঝু। ৯ই ফেব্রুয়ারী, পচেমস্ট্রমের ফাইনালে প্রতিপক্ষ শক্তিশালী ভারত। জয়সওয়াল-বিশ্নয়দের সামলানোর চেয়ে ঝুঝু কাটানোটাই যেন বেশ কঠিন গোটা বাংলাদেশের। কেননা বারবারই যে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে এই ভারতের কাছেই। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, দুই দুইটি এশিয়া কাপ ফাইনাল, ব্যর্থ নিদাহাস ট্রফির ফাইনালও। জেতা ম্যাচ হেরে যাওয়া, তীরে এসে তরী ডুবানো যেন টাইগারদের ‘রুটিন ওয়ার্ক’।
পুরো টুর্নামেন্টে অপরাজিত আকবরদের চিন্তা ভিন্ন। ম্যাচ তো ম্যাচই, ফাইনাল বলে কিছু নেই, নেই হাই কিংবা লো ভোল্টেজের মানসিকতাও। যেই চিন্তা সেই কাজ, টসে জিতে ভারতকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানায় অধিনায়ক। পরক্ষণেই অধিনায়কের সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করতে শুরু করে টাইগার বোলাররা।
শরীফুল-সাকিব-অভিষেকদের বোলিং তোপে ‘থ’ খেয়ে যায় ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং-লাইনআপ। মুহুর্মুহু আক্রমণ আর বাঘের থাবায় একের পর এক কুপোকাত ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। প্রথম শিকারী অভিষেক। জয়ের হাতে তালুবন্দি করেন ওপেনার সাক্সেনাকে। এরপর শরীফুল-সাকিব সম্মিলিত আক্রমণ অব্যাহত। টাইগারদের ধারালো বোলিংয়ের সামনে মাত্র ১৭৭ রানেই গুটিয়ে যায় ভারতের ইনিংস।
বিশ্বকাপ উচিয়ে ধরতে এবার বাংলাদেশের লক্ষ্য মাত্র ১৭৮ রান। হাতে আছে ৫০ ওভার এবং ১০টি উইকেট। ইনিংস ওপেন করতে আসা তানজিদ-ইমন করে ফেলেছেন টার্গেটের একতৃতীয়াংশ রান। বিনা উইকেটে ৫০! আশার আলো দেখতে পাওয়া বাংলাদেশের সামনে মুহূর্তেই নেমে আসে বিপর্যয়। ৫১-৭১ রান করতেই নেই ৫ উইকেটে। এরই মাঝে রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে ক্রিজ ছাড়তে হয় ওপেনার ইমনকেও।
দলীয় ষষ্ঠ উইকেট যখন প্যাভিলিয়নের পথ ধরে, ঠিক তখনই নেমে পড়েন ইমন। শত ব্যথা চাপিয়েও যে বিশ্বকাপটা ওদের চাই-ই। এ সুযোগ বার বার আসবে না, পাওয়া সুযোগটা কাজে লাগানোই চাই ইমনের। অধিনায়ক আকবর আলীর সঙ্গে দলকে জয়ের দিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেন তিনি। কুড়িয়ে কুড়িয়ে খেলা হাজারো স্লেজিংয়েও উত্তেজিত করতে ব্যর্থ হয় পুরো ভারতীয় শিবির।
দলের জয় প্রায় নিশ্চিত করে দিয়ে ব্যক্তিগত ৪৭ রানে আউট হন উড়িয়ে মারতে গিয়ে। ফিনিশিংটা দিয়ে আসেন অধিনায়ক। ৪৩ করা আকবর আলী দলের জয় নিশ্চিত করে মাঠ ছাড়ানে। রকিবুলের উইনিং শটে উল্লাশে ফেটে পড়ে গোটা দেশ। অধরা বিশ্বকাপের দুঃখ ঘুচলো টাইগারদের। স্বর্নাক্ষরে লেখা দিন ৯ই জানুয়ারি, ২০২০।