“অচল মানুষ”
মুশফিকুর রহমান
মোস্তফা বিয়ের আগেই কিছু টাকা জমিয়েছিল। ইচ্ছা ছিল বিয়ের পর গাজীপুর কিংবা আশুলিয়ার দিকে অল্প টাকায় স্থায়ী ভাবে বসবাসের জন্য ছোট একটা জমি কিনবে। কিন্তু বিয়ের পর বউয়ের ভালো একটা চাকরির খবর এল। রেলওয়েতে। হাতের সবগুলো টাকা মুনিয়ার চাকরি পেতেই শেষ হয়ে গেল।
মোস্তাফা এখন ঘর বসা। বয়স ৩৮ পেরিয়েছে। মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় চাইতে জীবনের ঘটে চলা প্রতিটি ঘটিনাই যেন আরও বেশি দূর্ঘটনার। বসে থেকে থেকে শরীরের এখন ভার চলে এসেছে। দাঁড়ি রেখেছে। প্রতিদিন শেভের জন্য আর খরচ হয় না। মুনিয়ার থেকে টাকা চাইতে হয় না। সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছাও মরে গেছে। ওয়াই ফাই লাইন গেল মাসে মুনিয়া বন্ধ করেছে। মোস্তফার ইচ্ছা এখন মুনিয়ার মধ্যে ভর করেছে। খরচ কমিয়ে টাকা জমাতে হবে। মুনিয়া খুব চেষ্টা করছে ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট কিনবে। দুই ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা এখন মোস্তফার চাইতে মুনিয়ার’ই বেশি।
আটার কেজি ৭০ ছাড়িয়েছে। রাতে মোস্তফা আগে রুটি খেত। এখন ভাত খেতে হয়। চায়ের কাপে মুনিয়ে ভাত মেপে দেয়। ছোট বোতলের তেল কিনে আনে। ১৯৮ টাকায় তেল কিনে ভাজাপোড়া খাওয়ার মেয়ে মুনিয়া না। তার ইচ্ছা নিজেদের আগে একটা মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হোক।
এমন টানাপোড়েনে মোস্তফা এখন মাসিক চেকআপে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। মুনিয়ার ইচ্ছাই এখন প্রাধান্য পায় এই সংসারে। অচল হয়ে ঘর বসা মানুষের ইচ্ছার কোনো মূল্য নেই।
একটা বিষয়ে মোস্তফার মন বড় বিষণ্ণ। ইদানিং ইচ্ছা করছে সবকিছু ছেড়েদিয়ে বহুদূরে চলে যাবে। সেদিন মুনিয়াও বলল মোস্তফাকে গ্রামে চলে যেতে। গ্রামে মোস্তফার বাবার করে যাওয়া ঘর আছে। সবকিছু তৈরি। শুধু মোস্তফাকে দেখাশুনা করার জন্য একজন লোক রেখে দিলেই হবে। মুনিয়ার বাজেট মাসে ১০ হাজার টাকা। তা-ও ভালো!
ঢাকায় থেকে মুনিয়ার এখন অনেক পরিচিত জন হয়েছে। তাঁরা বাসায় আসলে মুনিয়া মোস্তফাকে নিয়ে বিব্রতবোধ করে। ফ্ল্যাট বুকিং হয়ে গেছে। মোস্তফাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার তারিখ হয়ে গেছে। মুনিয়া নির্ভার বোধ করছে।
আজ সকালে নাস্তার টেবিলে মুনিয়া যখন অফিসে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করছে তখন মোস্তফা কথা পাড়ে…
মুনিয়া তোমাকে খুব ভালোবাসতাম
এখন ভাসো না?
এখনকার সময়ে আমার কিছুর মূল্য আছে? আগামীকাল কি তুমিই আমাকে গ্রামে দিয়ে আসবে?
আমার অফিসে অনেক কাজ আছে। আমি যেতে পারবো না। গাড়ি ঠিক করেছি। তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। – এই বলে মুনিয়া অফিসে চলে যায়।
মোস্তফা পাঞ্জাবির কোণ দিয়ে ছোখের পানি মুছে হুইল চেয়ার চালিয়ে বারান্দায় চলে আসে।
বেলা ১২ টায় ফ্ল্যাট কোম্পানির লোক এসে সব কাগজপত্র দিয়ে যায়। মোস্তফা ফাইল খুলে স্তব্ধ হয়ে পড়ে। ফ্ল্যাটটি মুনিয়া তাঁর নিজের নামেই কিনেছে। কোথায়ও মোস্তফার নাম নেই।
২০ ই মে মোস্তফা গ্রামে চলে যাচ্ছে। এই পথটি আজ নিজের কাছে খুব পাথুরে মনে হচ্ছে। গাড়ি যেন তাঁর হৃদয় ছেদ করেই ছুটছে। কারণ ২০ই মে এমন দিনে মুনিয়ার সাথে তার বিয়ে হয়েছিল। মুনিয়া ভূলেই গেছে এই দিনটির কথা। নাকি মুনিয়ার মনে ছিল। প্রিতিটি ২০ই মে বাসায় তাঁরা কেক কাটত। মুনিয়া ভালো-মন্দ রান্না করত। আজ রাতে কি রান্না হবে না?
রান্না হয়েছে। মুনিয়া বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত। মুনিয়া নির্ভার। আজ বন্ধদের সাথে, বাবার বাড়ির লোকদের সাথে ভালো একটা দিন পার করছে। মুনিয়া ছবি তুলেছে। সেই ছবিতে সবাই লাভ রিয়েক্ট দিচ্ছে। সবাই মুনিয়াকে ভালোবাসে।
শুধু ভালোবাসার মানুষটি দূরে।
অচল মানুষের মূল্য পরিবারে নেই। একটা সময় পরে অচল মানুষকে দূরে ঢেলে দিয়ে কাছের মানুষ তাঁর নিজের সুখ খুঁজে নেয়। এটাই রূঢ় বাস্তবতা।
মুশফিকুর রহমান
কলামিস্ট।